Showing posts with label Literature. Show all posts
Showing posts with label Literature. Show all posts

Wednesday, November 22, 2017

পৃথিবীর প্রথম কবি 'এনহেদুয়ান্না'

পৃথিবীর প্রথম কবি 'এনহেদুয়ান্না'

শিল্পির কল্পনায় এনহেদুয়ান্না
চন্দ্রদেবী সুয়েনের মন্দিরে ধ্যানমগ্ন এক যুবতী, পদ্মাসনে উপবিষ্ট। দুই হাতের করতল সংযুক্ত, ঈষৎ উত্তোলিত। বুকের দুপাশে নগ্ন স্তনের ওপর দুগাছি কালো চুল। সুডৌল বাহুযুগল, উন্মুক্ত পিঠ এবং ঊরুসন্ধির সঙ্গমস্থলে স্ফীত নিতম্ব, যা শ্বেতপাথরের ওপর ছড়ানো একতাল মসৃণ মাংসপিণ্ডের মতো পড়ে আছে। ধু ধু প্রান্তরে মৌন সন্ন্যাসীর মতো দাঁড়িয়ে আছে কয়েকটি ন্যাড়া বৃক্ষ। গোধূলিলগ্ন। সূর্যাস্তের এক চিলতে লাল আভা এসে পড়েছে দেবী সুয়েনের কপালে শোভিত মুকুটের ওপর। প্রার্থনামগ্ন আক্কাদিয়ান যুবতীর নগ্ন অবয়ব থেকে এক অলৌকিক আলোর উজ্জ্বল আভা বিকীর্ণ হচ্ছে। পেছনে সম্রাট সারগনের নেতৃত্বে আক্কাদ সাম্রাজ্যের গণ্যমান্য লোকজন। চন্দ্র দেবীর কাছে আজ ওদের একটিই প্রার্থনাতিনি যেন এই সাম্রাজ্যকে অসুর লুগাল এনের হাত থেকে রক্ষা করেন।

ওপরে বর্ণিত দৃশ্যটি আজ থেকে ৪ হাজার ২৭৪ বছর আগের, অর্থাৎ যিশুর জন্মের ২২৫৮ বছর আগের। এই প্রার্থনাসভার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন যে নারী, তাঁর নাম এনহেদুয়ান্না। তখন তিনি ২৭ বছরের পূর্ণ যুবতী। এনহেদুয়ান্না শব্দের অর্থ অন্তরীক্ষ দেবী। তিনি আক্কাদের সম্রাট সারগন ও তাঁর স্ত্রী রানি তাশলুলতুমের মেয়ে। অন্য এক মতে, এনহেদুয়ান্না সম্রাট সারগনের (যাঁকে পৃথিবীর সম্রাট বলে অভিবাদন জানানো হতো) মেয়ে নন, তবে রক্তের সম্পর্কিত আত্মীয়া।

এনহেদুয়ান্না ছিলেন অসম্ভব মেধাবী মানুষ; এক নারী, যিনি প্রার্থনাসংগীত ও কবিতা লিখতে পারতেন বলে তৎকালীন সমাজ তাঁকে দেবী হিসেবে পূজা করত। তাঁর পিতা সম্রাট সারগন কন্যা এনহেদুয়ান্নাকে রাজ্যের প্রধান পুরোহিতের সম্মানে ভূষিত করেন। এই পদটি মর্যাদা পেত রাজ্যের সবচেয়ে সম্মানিত পদ হিসেবে।

সারগনের মৃত্যুর পরে তাঁর পুত্র রামিস সম্রাট হলেও এনহেদুয়ান্না তাঁর স্বপদে বহাল থাকেন। ২২৮৫ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে জন্মগ্রহণকারী এই নারীই এযাবৎকালের আবিষ্কৃত প্রথম লেখক বা কবি। তিনি ৪২টি স্তবগান রচনা করেন, যা পরবর্তীকালে ৩৭টি প্রস্তরখণ্ড থেকে উদ্ধার করা হয়। এ ছাড়া তিনি দেবী ইনানার স্তুতি করে আরও বেশ কিছু শ্লোক রচনা করেন।

সুমেরু ভাষার ইনানাই আক্কাদিয়ান ভাষার ইস্তার, পরবর্তীকালে গ্রিকরা যাঁকে আফ্রোদিতি বলে শনাক্ত করে এবং রোমানরা তাঁকে ডাকে ভেনাস বলে, তিনি ছিলেন প্রেমের দেবী। দেবী ইনানার স্তুতি স্তাবকে সমৃদ্ধ এনহেদুয়ান্নার কবিতাগুলোই প্রার্থনাসভা-সংগীতের ভিত্তি নির্মাণ করে। সেই দিক থেকে তিনি ধর্মাবতারের কাজ করেছেন। তাঁর ওপর রাজা সারগনের ছিল পূর্ণ আস্থা। এনহেদুয়ান্নার মাধ্যমেই তিনি সুমেরু দেব-দেবীদের স্থলে আক্কাদিয়ান দেব-দেবীদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার কাজটি করেছিলেন, রাজ্য নিষ্কণ্টক রাখার জন্য এর প্রয়োজন হয়েছিল। এনহেদুয়ান্নার কাব্যপ্রতিভা তৎকালীন মেসিপটেমিয়ার নারীদের শিক্ষা গ্রহণে এগিয়ে আসতে অনুপ্রাণিত করে এবং রাজবংশের নারীদের কবিতা লিখতে উৎসাহিত করে। একসময় এটা প্রায় অবধারিতই হয়ে ওঠে যে রাজকন্যা ও রাজবধূরা অবশ্যই কবিতা লিখতে জানবেন। যদিও তাঁর সমসাময়িককালে আর তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো নারী কবির সন্ধান পাওয়া যায়নি। এতে এটাও প্রতীয়মান হয় যে পার্শি বি শেলির কথাই ঠিক, কবিতা একটি ঐশ্বরিক বা স্বর্গীয় ব্যাপার। তিনি অবশ্য স্বর্গীয় বলতে বুঝিয়েছেন মানুষের স্বর্গীয় অনুভূতির কথা।

এনহেদুয়ান্না সম্পর্কে প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ পল ক্রিওয়াসজেক বলেন, ‘তাঁর কম্পোজিশন, যদিও এই আধুনিককালেই কেবল পুনরুদ্ধার করা হলো, সর্বকালের অনুনয়মূলক প্রার্থনার মডেল। ব্যাবিলনীয়দের মাধ্যমে এর প্রভাব হিব্রু বাইবেলে এবং প্রাচীন গ্রিক প্রার্থনাসংগীতেও এসে পড়েছে। ইতিহাসের প্রথম কবি এনহেদুয়ান্নার ভীরু শ্লোকগুলোর প্রভাব প্রথম দিকের খ্রিষ্টান চার্চেও শোনা যেত।’

তখনকার প্রেক্ষাপটে নিয়মতান্ত্রিক প্রার্থনা মানুষের মধ্যে মানবতাবোধ তৈরিতে সহায়ক ছিল। রাজ্যে ও সমাজে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় ধর্ম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখত। যদিও দেব-দেবীরা যাঁদের নিয়ন্ত্রণে থাকতেন, অর্থাৎ রাজা বা গোত্রপ্রধানগণ ধর্মের নামে জনগণকে প্রতারিতও করতেন। তা সত্ত্বেও ধর্মই মানুষের অস্থির চিত্তকে নিয়ন্ত্রণে রাখার একমাত্র উপায় ছিল। সেই দিক থেকে পৃথিবীর প্রথম কবি এনহেদুয়ান্না প্রার্থনা শ্লোক বা দেব-দেবীর স্তুতিবাক্য রচনা করে একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছেন মানব সভ্যতার জন্য।

২২৫০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে মাত্র ৩৫ বছর বয়সে পৃথিবী থেকে বিদায় নেন পৃথিবীর প্রথম কবি এই মহীয়সী নারী। তিনি কোনো পুরুষ সঙ্গী গ্রহণ করেছিলেন কি না বা কোনো সন্তান জন্ম দিয়েছিলেন কি না এ সম্পর্কে কোনো তথ্য জানা না গেলেও এটা অনুমিত যে রাজ্যের প্রধান পুরোহিত হওয়ার কারণে হয়তো সংসারের মতো জাগতিক মায়ার বাঁধনে তিনি জড়াননি।

এই লেখায় পৃথিবীরপ্রথম কবি এনহেদুয়ান্নার কিছু শ্লোকের বাংলা অনুবাদ উপস্থাপনের চেষ্টা করছি। অনুবাদগুলো আমি করেছি ইংরেজি থেকে। এনহেদুয়ান্না যে পদ্ধতিতে লিখেছিলেন, সেই পদ্ধতিকে বলা হতো কিউনিফর্ম পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে ৩৪০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ থেকে লিখতে শুরু করে মেসিপটেমিয়ার অধিবাসীরা।


এনহেদুয়ান্নার শ্লোক

১.

আমি তোমার এবং সব সময় তোমারই থাকব

তোমার হৃদয় আমার জন্যে শীতল হোক,

তোমার চেতনা, সমবেদনা আমার প্রতি

                        করুণার্দ্র হোক

তোমার কঠিন শাস্তির স্বাদ আমি উপলব্ধি করেছি।

(তৃতীয় লাইনের কিছু অংশ উদ্ধার করা যায়নি। ‘করুণার্দ্র’ শব্দটি যোগ করা হয়েছে চরণকে অর্থবহ করার জন্য। এনহেদুয়ান্নার শ্লোক: ১২)

২.

আমার দেবী, আমি ভূমণ্ডলে তোমার মহানুভবতা ও মহিমা ঘোষণা করছি

আমি চিরকাল তোমার মহানুভবতার

                        গুণগান করে যাব।

(শ্লোক: ১৩)

৩.

রানি যে বড় কাজগুলো করেন তা নিজের জন্য

তিনি জড়ো করেন নিজের স্বর্গ-মর্ত্য

তিনি মহান দেবীর প্রতিদ্বন্দ্বী।

(শ্লোক: ১৬)

৪.

দেবরাজ, শ্বাস-প্রশ্বাস এবং বাতাসের দেবী এই মহাবিশ্বকে করেছে তোমার দিকে ধাবমান

হে দেবীদের দেবী ইনানা, তোমার পদতলে

                        অর্পিত মহাবিশ্ব

তুমিই নির্ধারণ করো রাজকন্যাদের ভাগ্য।

(শ্লোক: ১৮)

৫.

মহীয়সী, তুমি সুমহান, তুমি গুরুত্বপূর্ণ

ইনানা তুমি মহান, তুমি গুরুত্বপূর্ণ

আমার দেবী, তোমার মহানুভবতা উদ্ভিন্ন

আমার দোহাই তোমার হৃদয় ফিরে যাক যথাস্থানে।

(শ্লোক: ১৯)

সূত্রঃ প্রথম আলো হতে সংগৃহিত



Thursday, November 2, 2017

দেবদাসনামা

দেবদাসনামা


শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (15 সেপ্টেম্বর, 1876  - 16 জানুয়ারী 1938)
উপন্যাস মধ্যবিত্ত সমাজের সৃষ্টি। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে বাংলার মধ্যবিত্ত শ্রেণি কলকাতা শহরের সংস্কৃতিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠতে শুরু করেছে। তখন গ্রামের জীবন ও সমাজ ছিল সামন্তপ্রথার শিকড়ে বাঁধা। এই ক্রান্তিকালে একের পর এক উপন্যাস লিখে যাওয়া ছিল অসম্ভব না হলেও কঠিন। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এই কঠিন কাজটি করে জনপ্রিয়তার শিখরে উঠেছিলেন। বিংশ শতকের যে সময় তিনি সাহিত্যচর্চা করেন, সেই সময় আর কেউ তাঁর মতো এত বিপুলসংখ্যক উপন্যাস লেখেননি। তাঁর সব উপন্যাসই পাঠকপ্রিয় হয়েছিল—এটাও বিস্ময়কর। বাঙালি উঠতি মধ্যবিত্ত শ্রেণির হৃদয় তিনি স্পর্শ করতে পেরেছিলেন তাঁর লিখনশৈলীর মাধ্যমে। শরৎচন্দ্রের দেবদাস উপন্যাসটি এর ব্যতিক্রমী কাহিনি ও অবিস্মরণীয় চরিত্রের জন্য লেখকের সমকালে এবং পরবর্তী সময়ে বাঙালির জীবনে বহুল আলোচিত শুধু নয়, বৈচিত্র্যের মাত্রাও যোগ করেছিল, যা তাঁর অন্য কোনো উপন্যাসের ক্ষেত্রে ঘটেনি। তাই এই উপন্যাস প্রকাশের শতবর্ষে দাঁড়িয়ে এখন এটা বলাই যায়, দিনে দিনে বাঙালি সংস্কৃতির অংশ হয়ে উঠেছে দেবদাস।


শরৎচন্দ্রের সব উপন্যাস মধ্যবিত্ত শ্রেণির পুরুষ ও নারী চরিত্র নিয়ে লেখা হলেও তাদের জীবনের প্রেক্ষাপটে ছিল আধা সামন্ততান্ত্রিক ও আধা পুঁজিবাদী সমাজের নানা টানাপোড়েন। গ্রামীণ জীবনের অচলায়তন এবং শহরে আংশিক মুক্ত জীবনযাপনের মধ্যে ছিল দ্বন্দ্ব-সংঘাত। শরৎচন্দ্রের উপন্যাসে নারী-পুরুষ চরিত্রের জীবনে যে জটিলতা ও সমস্যা, তার পেছনে প্রায় ক্ষেত্রেই কারণ হিসেবে ক্রিয়াশীল এই দ্বন্দ্ব-সংঘাত। সমাজই তাঁর প্রায় সব উপন্যাসে প্রধান পটভূমি। একমাত্র দেবদাস উপন্যাসেই তিনি সৃষ্টি করেছেন নায়ককেন্দ্রিক কাহিনি, যদিও এই নায়ক চরিত্র সমাজনিরপেক্ষ হয়ে স্বাধীনভাবে আচরণ করতে পারেনি। যে বৈশিষ্ট্যের কারণে জনপ্রিয়তার দিক দিয়ে দেবদাস শরৎচন্দ্রের অন্য উপন্যাসগুলোকে অতিক্রম করেছে, তা এর ট্র্যাজিক কাহিনি। তাঁর অন্য উপন্যাসে ট্র্যাজেডি এমন প্রাধান্য পায়নি। মূল চরিত্রের ট্র্যাজেডি বিশ্বাসযোগ্যভাবে আবেগের কাছে উপস্থাপনের কারণে দেবদাস সমকালে প্রবল জনপ্রিয়তার পাশাপাশি ধ্রুপদি উপন্যাসের মর্যাদাও লাভ করেছে। ধ্রুপদি সাহিত্যের আবেদন চিরকালের। দেবদাস যে ধ্রুপদি উপন্যাস, তার প্রমাণ এটি নিয়ে বিভিন্ন ভাষায় একের পর এক চলচ্চিত্র নির্মাণ এবং বইটি প্রকাশনার শতবর্ষে আবেগে-ভালোবাসায় স্মরণ।

দেবদাস-এর প্রতি কেন এই প্রায় নিরবচ্ছিন্ন আবেগ ও ভালোবাসা? প্রধান কারণ এর ট্র্যাজিক কাহিনি। দ্বিতীয় কারণ অনবদ্য ভঙ্গিতে সেই কাহিনির বর্ণনা। প্রাচীনকালে যখন সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছে, ট্র্যাজেডির সূচনা ছিল পুরোভাগে। গ্রিসে কমেডি রচয়িতা অ্যারিস্তোফেনিস ছাড়া আর সব নাট্যকার—যেমন এক্সিলাস, সফোক্লিস ও ইউরিপিডিস ট্র্যাজিকধর্মী নাটক লিখে দর্শকদের আকর্ষণ করেছেন। এই আকর্ষণের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলা হয়েছে, দর্শকেরা নাটক দেখে তাদের মনে জমে থাকা আবেগকে মুক্ত (ক্যাথারসিস) করতে পেরে যতটা আনন্দ পায়, অন্য ধরনের নাটক দেখে সেই পরিমাণে নয়। অনেক পরে লিও তলস্তয় আর্টের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন, মানুষের আবেগ প্রকাশই আর্ট। কমেডিও মানুষের মন থেকে একধরনের আবেগকে মুক্ত করে আনে কিন্তু সেই আবেগের গভীরতা ট্র্যাজিক আবেগের সঙ্গে তুলনীয় নয়। ‘ক্যাথারসিসের অভিজ্ঞতার জন্যই পাঠক (দর্শক) দেবদাস উপন্যাসের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল—এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। অশ্রুপাত করে মনকে হালকা করার মতো দৈবিক প্রক্রিয়া দ্বিতীয়টি নেই। শুধু প্রেম-ভালোবাসায় ব্যর্থ হয়েই মানুষ ট্র্যাজিক অনুভূতির অভিজ্ঞতা লাভ করে না। তার জীবনে ট্র্যাজেডি নানাভাবে, বিভিন্নরূপে ঘটতে পারে। যার জন্য এর সঙ্গে কেউই অপরিচিত নয়। আবার ট্র্যাজেডি যখন অন্যের জীবনে ঘটে, সেই ঘটনা দেখে বা শুনে আবেগে আপ্লুত হয় স্বাভাবিক চরিত্রের মানুষেরা। বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসে সফলভাবে লেখা প্রায় সব ট্র্যাজিক কাহিনিই পাঠকের (দর্শকের) মনে এই প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পেরেছে। আধুনিক বাংলা সাহিত্যে দেবদাসই প্রথম উপন্যাস, যেখানে ট্র্যাজেডিই প্রধান উপজীব্য। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে শরৎচন্দ্রের অতুলনীয় লেখনীভঙ্গি। ফলে দেবদাস-এর ধ্রুপদি মর্যাদা লাভ ছিল অবধারিত। দেবদাস বিংশ শতকের প্রথম দিকে (১৯১৭-কে প্রকাশনাকাল মনে করে) অবিভক্ত বাংলায় গ্রামের এক জমিদারের দ্বিতীয় পুত্র। ছেলেবেলা থেকেই সে বেশ সরল, নির্মল চরিত্রের ও বৈষয়িক জ্ঞানশূন্য। গ্রামের স্কুলে পড়ার সময় তার সখ্য গড়ে উঠেছে তাদের প্রতিবেশী এক পরিবারের মেয়ে পার্বতীর সঙ্গে। পার্বতীর বাবা সাধারণ মানুষ, জমিদারের সমপর্যায়ের নন। জাতের দিক দিয়েও দেবদাসের পরিবার নিচের সারিতে। গ্রামে স্কুলের পড়া শেষ করার আগেই দেবদাসকে পাঠিয়ে দেওয়া হলো কলকাতায়। বয়স বেড়ে যৌবনে উপনীত হলে পার্বতীর পিতামহী দুজনের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক মনে রেখে দেবদাসের মায়ের কাছে ওদের বিয়ের প্রস্তাব দিলেন। স্ত্রীর কাছে এ কথা জানার পর ক্ষুব্ধ হলেন দেবদাসের বাবা। তিনি উচ্চবংশীয় জমিদার হয়ে সাধারণ-নীচু জাতের পরিবারের মেয়ের সঙ্গে ছেলের বিয়ে দেবেন না—এমনই তাঁর মনোভাব। অগত্যা মনঃক্ষুণ্ন হয়ে দেবদাস চলে যায় কলকাতায়। সেখান থেকে পার্বতীকে চিঠি লিখে সে জানায়, তাকে সঙ্গী করার জন্য মা-বাবার মনে কষ্ট দেওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। চিঠিটি কাজের লোককে দিয়ে পোস্ট করার পর দেবদাসের মনে অনুশোচনা দেখা দেয়। তার বিবেক তাকে ভর্ৎসনা করে। তাড়াতাড়ি ভুল সংশোধনের জন্য গ্রামে যায় সে। কিন্তু এর আগেই পার্বতী দেবদাসের লেখা মর্মঘাতী চিঠিটি পড়ে ফেলেছে। পুকুরঘাটে দেখা করে দেবদাস পার্বতীকে জানায়, তার মা-বাবাকে রাজি করাবে সে। কিন্তু এতে বাধ সাধে পার্বতী—আত্মমর্যাদা রক্ষায় কিছুটা উষ্মার সঙ্গে, কিছুটা অভিমানে দেবদাসের পরিবারের সমালোচনা করে নিজের অসম্মতি জানায় সে। অতঃপর হতাশ হয়ে দেবদাস ফিরে আসে কলকাতায়। একই মেসে থাকা চুনীলালের উৎসাহে নিজের দুঃখ ভোলার জন্য সে পতিতাপল্লিতে যেতে শুরু করে। সেখানে দেখা হয় চন্দ্রমুখীর সঙ্গে। বারবনিতা চন্দ্রমুখীকে প্রথমে ঘোরতর অপছন্দ হলেও মেয়েটির মধুর ব্যবহারে ক্রমে তার সঙ্গে পছন্দ-অপছন্দমিশ্রিত একধরনের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে দেবদাস।

কাহিনির শেষ পর্যায়ে দেখা যায়, চন্দ্রমুখীর সেবা-যত্নে পরিবৃত হয়েও বিরহব্যথা ভোলার উদ্দেশ্যে অনির্দিষ্ট গন্তব্যে ট্রেনযাত্রা করে দেবদাস। তত দিনে অতিরিক্ত মদ্যপানে গুরুতর অসুস্থ সে। যাত্রাকালে ট্রেন অনেক স্থানে থামে কিন্তু দেবদাস নামে না কোথাও। তার অসুস্থতা যখন চরমে পৌঁছায়, সেই সময় ট্রেন থামে পাণ্ডুয়া স্টেশনে। দেবদাসের মনে পড়ে, কাছেই মানিকপুর গ্রামে বিয়ে হয়েছে পার্বতীর। তার আরও মনে পড়ে, নিজের ওপর সব অভিমান-অভিযোগ ভুলে পার্বতী তাকে বলেছিল, দেবদাস যেন মানিকপুরে আসে, পার্বতী যেন তাকে সেবা করার সুযোগ পায়। দেবদাস ট্রেন থেকে নেমে গরুর গাড়িতে মানিকপুর গ্রামের উদ্দেশে যাত্রা করে। কিন্তু গন্তব্যে এসে যখন পৌঁছায়, তখন তার শেষনিশ্বাস ফেলার সময়। পার্বতীর সঙ্গে তার দেখা হয় না।

দেবদাসের জীবনের ট্র্যাজেডির পেছনে রয়েছে সামন্তপ্রথাভিত্তিক সমাজের মূল্যবোধ আর জাতিভেদ। কলকাতায় থেকে পড়াশোনা করলেও স্বাধীনচেতা হতে পারেনি সে। তাই তার বাবা যখন জমিদারি এবং উচ্চবর্ণের কথা বলে পার্বতীর সঙ্গে তার বিয়ের প্রস্তাব ঘৃণাভরে নাকচ করে দেন, দেবদাস প্রতিবাদের দিকে না গিয়ে উল্টো দিকে ফিরে যায়। এখানে সে নীরব প্রতিবাদের ঊর্ধ্বে উঠে বিদ্রোহী হতে পারে না। দেবদাস চরিত্রের ব্যর্থতা এখানেই—পার্বতীর ভালোবাসাকে প্রাধান্য দিয়ে মা-বাবার অমতে তাকে বিয়ে করতে পারে না সে। সামন্ত সমাজের মূল্যবোধের কাছে পরাজিত হয় তার ব্যক্তিগত ইচ্ছা-সাধ। কলকাতায় শিক্ষা লাভ করার পরও মধ্যবিত্তের যে প্রধান বৈশিষ্ট্য—ব্যক্তিগত স্বাধীনতাবোধ—দেবদাস তা অর্জন করতে পারেনি। কেননা, তার সামাজিক পর্যায়ক্রম ছিল সামন্তপ্রথার অচলায়তন।

সামন্তপ্রথা ও স্বীয় পরিবারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে নিজের ইচ্ছা পূরণ করতে না পারলেও দেবদাস শাস্তি দেয় এবং তা নিজেকেই। মদ্যপান করে সে এমন অসুস্থ হয়ে পড়ে যে তার পক্ষে বেঁচে থেকে স্বাভাবিক জীবনযাপন আর সম্ভব হয় না।

পার্বতীর সঙ্গে বিয়ে নিয়ে দেবদাসের চরিত্রে যে সিদ্ধান্তহীনতার পরিচয় পাওয়া যায়, তার সঙ্গে তুলনীয় উইলিয়াম শেক্‌সপিয়ারের হ্যামলেট চরিত্রের। ‘টু বি অর নট টু বি’র মতো তার মনেও দেখা দেয় সিদ্ধান্তহীনতা এবং আত্মসমর্পণের অসহায়তা। অ্যারিস্টটলসহ পরবর্তী সময়ে অনেকেই বলেছেন, একজন মানুষের জীবন ট্র্যাজিক হয়ে ওঠে তার চারিত্রিক ত্রুটি-বিচ্যুতির জন্য। এর পাশাপাশি ট্র্যাডেজির অন্য ব্যাখ্যাও আছে—বলা হয় ভুলের জন্যই ট্র্যাজেডি ঘটে। এই শেষের ব্যাখ্যাই যুক্তিসংগত মনে হয়। ত্রুটিপূর্ণ চরিত্র হলে একজনের জীবনে একের পর এক ট্র্যাজেডি ঘটতেই থাকবে। কিন্তু বাস্তবে তেমন হয় না, অন্তত গুরুতর আকারে নয়। বড় ট্র্যাজেডি একটাই ঘটে মানুষের জীবনে, যা হয়েছে দেবদাসের ক্ষেত্রে। এখানে তার চারিত্রিক দোষ-ত্রুটি কারণ হিসেবে কাজ করেনি, যেমন করেছে তার ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণ অথবা সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যর্থতায়। দেবদাসের মনে টানাপোড়েন। হ্যামলেটীয় সিদ্ধান্তহীনতা, এসব তার ভুলের জন্যই হয়। সামন্তপ্রথার প্রতিভূ তার জমিদার বাবার বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যর্থতাও এই ভুলের অন্তর্গত। অন্তর্দ্বন্দ্বে জর্জরিত বিরহকাতর দেবদাসের জীবনের করুণ পরিণতি পাষাণহৃদয় পাঠক-দর্শককেও বিষাদগ্রস্ত করে, তাদের অশ্রু নেমে আসে। ক্যাথারসিস সৃষ্টির এই সফলতাই দেবদাস উপন্যাসের জনপ্রিয়তার প্রধান কারণ।

দেবদাস উপন্যাসের কাহিনি নিয়ে বাংলা ও হিন্দিতে একাধিক চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও যে হবে, তাতে সন্দেহ নেই। কেননা, দেবদাসের কাহিনির আবেদন চিরন্তন। অবশ্য ভবিষ্যতের সেই সিনেমা এই কাহিনির প্রতি আর বিশ্বস্ত থাকবে বলে মনে হয় না।

দেবদাস-এর প্রথম সিনেমা-রূপান্তর হয়েছে ১৯২৮ সালে। এটি ছিল নির্বাক ছবি। এরপর ১৯৩৫ ও ’৩৬ সালে নির্মিত হলো আবার। এই দুটি অবশ্য সবাক। প্রথমটি বাংলায়, দ্বিতীয়টি হিন্দিতে। পরে ১৯৫৩-তে তামিল এবং ’৬৫-তে উর্দু ভাষায়ও নির্মিত হয়েছে দেবদাস।

অসংখ্য দেবদাস সিনেমার মধ্য থেকে বিখ্যাত দু-একটি কাহিনিচিত্র সম্পর্কে খানিকটা বলা যাক। প্রমথেশ বড়ুয়ার পরিচালনা এবং তাঁর ও যমুনার অভিনয়সমৃদ্ধ বাংলা ভাষার দেবদাস (১
৯৩৫) কিংবা বিমল রায় পরিচালিত দিলীপকুমার ও সুচিত্রা সেন অভিনীত হিন্দি দেবদাস-এর (১৯৫৫) চলচ্চিত্রায়ণ যতটা উপন্যাসানুগ, এর অনেক পরের ঐশ্বরিয়া রাই ও শাহরুখ খান অভিনীত সঞ্জয় লীলা বানসালির দেবদাস (২০০২) তেমন নয়। শুধু প্রমথেশ বড়ুয়া আর বিমল রায়ের শিল্পজ্ঞানভিত্তিক দক্ষ পরিচালনার জন্য নয়, সিনেমা তৈরির নান্দনিকতার কারণেও সাম্প্রতিককালে সঞ্জয় লীলা বানসালির দেবদাসের সঙ্গে আগের সিনেমাটির পার্থক্য আকাশ-পাতালের। প্রথম দুজন চেয়েছেন উপন্যাসের নান্দনিকতা ক্ষুণ্ন না করে শিল্প সৃষ্টি করতে আর শেষোক্ত পরিচালকের উদ্দেশ্য ছিল বাণিজ্যিক ফর্মুলা অনুযায়ী দর্শকের মনোরঞ্জন, বক্স অফিসের সাফল্যই যেন প্রধান বিবেচ্য। বানসালির দেবদাস কেবল রঙিন নয়, নাচে-গানে ভরপুর, যা বিনোদনের প্রয়োজন মেটায়, কিন্তু কতটা শিল্প সৃষ্টি করে তা প্রশ্নসাপেক্ষ। কাহিনি উপস্থাপনার ক্ষেত্রে ট্র্যাজেডিতে যে গাম্ভীর্য আর করুণ আবহ থাকে, বানসালির দেবদাস-এ সেটা জাঁকজমকপূর্ণ পরিবেশ ও উজ্জ্বল রঙের ভেতর হারিয়ে গেছে।

একই পরিণতি ঘটেছে ইংরেজি ভাষার ধ্রুপদি ট্র্যাজেডি এমিলি ব্রন্টের উদারিং হাইটস উপন্যাসের চলচ্চিত্রায়ণে। লরেন্স অলিভিয়ের ও মার্ল ওবেরন অভিনীত চলচ্চিত্রটির সঙ্গে এমটিভি প্রযোজিত উদারিং হাইটস-এর পার্থক্যও একই রকমের। প্রথমটিতে উপন্যাসের প্রতি নির্ভরতা যতটা মুখ্য, শেষেরটিতে মুক্তভঙ্গিতে কাহিনি নির্মাণ ও মূল উপন্যাস থেকে সরে আসার কারণে কাহিনির প্রতি বিশ্বস্ততা আর থাকেনি। এমটিভির চলচ্চিত্রটি পপ সংস্কৃতি অনুসরণে রক ও পপ সংগীত ব্যবহারের মাধ্যমে টিনএজদের বিনোদনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করেছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, এসব প্রচেষ্টা অবশ্যই নতুন প্রজন্মকে আকৃষ্ট করার জন্য। সময়ের পরিবর্তনে মানুষের রুচি বদলায়, কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে পরিচালক-প্রযোজক ধ্রুপদি কোনো সাহিত্যকর্ম বিকৃত করবেন কেবল দর্শকের মনোরঞ্জনের জন্য।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশে নির্মিত বুলবুল আহমেদ ও কবরী অভিনীত দেবদাস (১৯৮২) কাহিনির প্রতি বিশ্বস্ত থেকে চাষী নজরুল ইসলামের দক্ষ পরিচালনা এবং চরিত্র দুটিতে কুশলী অভিনয়ের জন্য বিশ্বাসযোগ্য হয়ে দর্শক-সমালোচক—উভয়েরই প্রশংসা অর্জন করেছে। মূলধারার বাণিজ্যিক ছবির গড্ডলিকা প্রবাহে সিনেমাটি বিসর্জিত হয়নি।

ট্র্যাজেডির কাহিনি মানুষের হৃদয়ের অন্তস্তলে গভীরতম ও বিষাদময় অনুভূতি স্পর্শ করে। এই অনুভূতি যেমন মানুষের ব্যর্থতার প্রতিনিধিত্ব করে, একই সঙ্গে প্রকাশ করে তার অপাপবিদ্ধতা ও মহত্ত্ব। এভাবে ট্র্যাজেডি একটি চরিত্রকে জীবনের চেয়ে বড় মাপের করে তোলে। এ কারণেই শরৎচন্দ্রের দেবদাস সর্বকালের মানুষের হৃদয়ের কাছে আবেদন রেখে কালজয়ী হয়েছে। শতবর্ষ পরও বইটি স্মরণীয় হয়ে থাকবে তার চিরন্তন মানবিক পরিচয়ের জন্য।
উত্তম কুমার ও সৌমিত্র চট্রোপাধ্যায়, কলকাতায় নির্মিত দেবদাস 1979

কবরী ও বুলবুল আহমেদ, বাংলাদেশে নির্মিত দেবদাস 1982

ঐশ্বরিয়া রাই ও শাহরুখ খান, বলিউডে নির্মিত দেবদাস, 2002

দেবদাসনামা

‘বোতল খাইয়া লেখা’

দেবদাস শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রথম জীবনের রচনা। কিশোর বয়সে তিনি যখন বিহারের ভাগলপুরের খঞ্জরপুর পল্লিতে থাকতেন, সে সময় লুকিয়ে উপন্যাসটি লেখা শুরু করেন। যদিও এ লেখা নিয়ে তিনি এক ধরনের দোলাচলে ভুগেছেন। ১৯১৩ সালের জুন মাসে বন্ধু প্রমথনাথ ভট্টাচার্যকে লেখা এক চিঠিতে দেবদাস বিষয়ে জানিয়েছিলেন, ‘শুধু যে ওটা আমার মাতাল হয়ে লেখা তাই নয়, ওটার জন্যে আমি নিজেও লজ্জিত।...’ একই বছরের ১৭ জুলাই প্রমথনাথকে লেখা আরেক চিঠিতে ওই বিষয়ে আরও বলেছেন, ‘ওই বইটা একেবারে মাতাল হইয়া বোতল খাইয়া লেখা।’

সূত্র: শরৎচন্দ্র, গোপালচন্দ্র রায়

প্রকাশের ইতিকথা

সম্ভবত বন্ধু ও প্রকাশকের তাগাদার কারণেই শরৎচন্দ্র পরে দেবদাস কিছুটা ঠিকঠাক করে ছাপার ব্যাপারে মনস্থির করেন। ভারতবর্ষ পত্রিকার ১৩২৩ বঙ্গাব্দের চৈত্র ও ১৩২৪-এর বৈশাখ-আষাঢ় সংখ্যায় উপন্যাসটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। ভারতবর্ষ গোষ্ঠীরই মালিকানাধীন প্রকাশনা সংস্থা গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় অ্যান্ড সন্স থেকে ১৯১৭ সালের জুন মাসের ৩০ তারিখে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় উপন্যাসটি। এ জন্য অগ্রিম পারিশ্রমিক হিসেবে লেখক পেয়েছিলেন দুই হাজার টাকা।

সূত্র: শরৎচন্দ্র, গোপালচন্দ্র রায়

চরিত্রের উৎস-সন্ধানে

হিন্দি ভাষায় শরৎ-জীবনীকার বিষ্ণু প্রভাকরের ধারণা, পার্বতী চরিত্রের মূলে রয়েছে শরৎচন্দ্রের বিদ্যালয়-জীবনের এক বান্ধবী ধীরু। তাঁর প্রতি শরতের মোহ ও ভালোবাসা খুব সহজে যায়নি। সেই ব্যর্থ প্রেমের স্মৃতিই তিনি পার্বতী চরিত্রে ধরে রাখার চেষ্টা করেছিলেন। চন্দ্রমুখীর চরিত্র আদতে কালিদাসী নামের এক বাস্তব নর্তকীর ওপর ভিত্তি করে রচিত। এক বন্ধুর সঙ্গে লেখক সেই নর্তকীর গান শুনতে গিয়েছিলেন। আর ধর্মদাসের চরিত্রটি গড়ে উঠেছে তাঁর মামার বাড়িতে দেখা এক সেবকমশাইকে কেন্দ্র করে। সূত্র: ছন্নছাড়া মহাপ্রাণ, বিষ্ণু প্রভাকর, অনুবাদ: দেবলীনা ব্যানার্জি কেজরিওয়াল

‘আসল’ পার্বতী!

পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার কালনার একটি গ্রাম হাতিপোতা। সেখানকার এলাকাবাসীর এখনো বিশ্বাস যে দেবদাস উপন্যাসের পার্বতী আসলে ছিলেন গ্রামের সাবেক জমিদার ভুবনমোহন চৌধুরীর দ্বিতীয় স্ত্রী! আর শরৎচন্দ্রও নাকি স্বয়ং এসেছিলেন হাতিপোতা গ্রামে। তখনই তিনি জানতে পারেন দেবদাস-পার্বতীর কাহিনি। এই ধারণার পালে আরও হাওয়া দিয়েছে উপন্যাসের এই কটি বাক্য: ‘পার্বতীর পিতা কাল বাটী ফিরিয়াছেন। এ কয় দিন তিনি পাত্র স্থির করিতে বাহিরে গিয়াছিলেন।...প্রায় কুড়ি-পঁচিশ ক্রোশ দূরে বর্ধমান জেলার হাতিপোতা গ্রামের জমিদারই পাত্র।’ এমনকি উপন্যাসে উল্লিখিত পাণ্ডুয়া রেলস্টেশন ও হাতিপোতা গ্রামের দূরত্বও নাকি বাস্তবের সঙ্গে মিলে যায়, এমনটাই দাবি গ্রামবাসীর। সূত্র: আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৮ আগস্ট ২০১২

চলচ্চিত্রে দেবদাস-ঝড়

দেবদাস-এর কাহিনি নিয়ে এখন পর্যন্ত বিভিন্ন দেশে ও ভাষায় নির্মিত চলচ্চিত্রের সংখ্যা ১৬। ১৯২৯ সালে দেবদাস অবলম্বনে নির্বাক চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। নীতিশচন্দ্র মিত্রের পরিচালনায় সেই ছবিতে দেবদাস চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন ফণী বর্মা। প্রযোজনায় ছিল ইস্টার্ন ফিল্ম সিন্ডিকেট। ১৯৩৫-এ দেবদাস আসে সবাক চলচ্চিত্র হিসেবে। নিউ থিয়েটার্সের প্রযোজনায় ছবির পরিচালনা ও নায়কের ভূমিকায় ছিলেন প্রমথেশ বড়ুয়া। তিনি পরে হিন্দি ও অসমিয়া ভাষায়ও দেবদাস নির্মাণ করেন।

১৯৭৯ সালে উত্তম কুমার ও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় একসঙ্গে অভিনয় করেন দেবদাস ছবিতে। িদলীপ রায় িনর্মিত এ িসনেমায় সৌমিত্র ছিলেন দেবদাস ও উত্তম ছিলেন চুনীলালের ভূমিকায়। আর পার্বতী চরিত্রে িছলেন সুমিত্রা মুখোপাধ্যায়। উর্দুতেও নির্মিত হয়েছে দেবদাস। বাংলাদেশে দেবদাস-কাহিনি অবলম্বনে মোট দুটি সিনেমা নির্মিত হয়, দুটির পরিচালকই প্রয়াত চাষী নজরুল ইসলাম। সূত্র: ওগউই

দেবদাস (ডাউনলোড লিংক)



শিল্প আসলে কি?

শিল্প আসলে কি?

শিল্প মানে সৃষ্টি! আর শিল্পীরা হচ্ছেন সেই সৃষ্টির কারিগর। প্রত্যেকটা শিল্পীর নিজস্ব চিন্তা, ধ্যান-ধারনা, আবেগ-অনুভূতি তার নিজের শিল্পের মধ্যে ফুটিয়ে তোলে। যিনি গান করেন তার সৃষ্টিশীলতা তার কন্ঠে যা কিনা নিজের আবেগ আর দরদ দিয়ে অপূর্ব ভাবে নিজের কথা গুলো গানের সুরে সুরে বলে উঠে। যিনি নাচেন তার সৃষ্টি তার পায়ের তালে আর অঙ্গি-ভঙ্গীতে যা সে নিজেই সৃষ্টি করেছেন ! কবি-লেখকদের নাটক, উপন্যাস, কবিতা, কাব্য রচনা সবি তাদের নিজস্ব কল্পনা দিয়ে গড়া। একজন ছবি আঁকার শিল্পী তাই তাদের ুলিতে ফুটিয়ে তোলে যা সে নিজের মত করে কল্পনা করেন! আমার কাছে ছবি আঁকার এই শিল্পটা বেশ লাগে! যখনি কোনো ছবি আঁকার এ্যাক্সিবিসন অথবা কোনো গ্যালারিতে যাই অনেকটা মুগ্ধ হয়েই অবলোকন করি শিল্পীর তুলির আঁকা রং গুলির। কি সাংঘাতিক ভাবে তারা তাদের কল্পনা গুলো কতগুলো রং দিয়ে ফুটিয়ে তোলে। তার মানে প্রত্যেটা শিল্পীই নিছক কল্পনাবিলাশী ছাড়া আর কিছু নয়! বুঝলাম সৃষ্টিশীল হতে হলে কল্পনাবিলাশী হতে হয়! এক একটা শিল্পীর কল্পনা এক এক রকম। আবার তাদের এই কল্পনা গুলো সাধারন মানুষগুলোর সাথে মিলে যায় বলেই তাদের মাঝে শিল্পীরা জায়গা করে নিতে পারে! খ্যাতি অর্জন করতে পারে সেই সব শিল্পীরাই যাদের সৃষ্টি আর সৃজনশীলতা সবার কাছেই সহজেই বোধগম্য। যিনি প্রেমিক সেও শিল্পী। কারন তার ভালবাসার মানুষটাকে ভালবাসা প্রকাশ করার জন্য কিন্তু সে নানা রকম অপূর্ব কিছু মিথ্যে কল্পনার আশ্রয় নেয়, কিন্তু তাতে কি, ভালবাসার মানুষটাতো খুশী!
যাইহোক, সৃষ্টিশীল হতে গেলে কল্পনাবিলাশী হওয়া ভাল, আর নিজের কল্পনাকে অপূর্বভাবে ফুটিয়ে তোলার জন্য কিছু মিথ্যের আশ্রয় নেয়াটা দোষের কিছু না হলেও খুব একটা গ্রহণযোগ্য যে হবে তা জোর করে বলা বাহুল্য! কারন কল্পনা আর মিথ্যের মধ্যে একটা সূক্ষ পার্থক্য বোধহয় থেকেই যায়!
প্রিয় পাঠকেরা আপনারাই বলতে পারবেন এর সূক্ষ পার্থক্য কারন শিল্পীদের এই কল্পনা শুধু আপনাদের নিছক কিছু আনন্দ দেয়ার জন্যই অসাধারন ভাবে ফুটিয়ে তোলা!

Tuesday, October 31, 2017

“জীবন প্রকৃতিগতভাবেই যেমন সুন্দর তেমন অপ্রকৃতিস্থ” -- জর্জ স্যান্ডার্স

“জীবন প্রকৃতিগতভাবেই যেমন সুন্দর তেমন অপ্রকৃতিস্থ” -- জর্জ স্যান্ডার্স

জর্জ স্যান্ডার্স এর প্রথম উপন্যাস ‘লিংকন ইন দ্য বার্ডো’ লিখে তিনি ম্যান বুকার জিতেছেন।  

প্রশ্নঃ  আব্রাহাম লিংকনের ওপর অনেক বই লেখা হয়েছে , আরও একটা কেন?

জর্জ স্যান্ডার্স: সত্যি বলতে, আমি লিংকনকে নিয়ে লিখতে চাইনি, কিন্তু প্রায় বিশ বছর আগে মাঝরাতে সদ্যমৃত ছেলের সমাধিতে লিংকনের প্রবেশের গল্পটি যখন শুনি, ভীষণভাবে তাড়িত হইয়েছিলাম তখন মূলত লিংকন ইন দ্য বার্ডো উপন্যাসের ভেতর দিয়ে আমি আগের সেই বিমোহিত অনুভূতির ভেতর প্রবেশ করতে চেয়েছি এরপর লিংকনকে নিয়ে লিখতে যাওয়াটা প্রয়োজন হয়ে উঠেছে, চাপ মুক্তির জন্য নিজেকে এই বলে শুরু করি যে আমি লিংকনকে নিয়ে বড়সড় করে বিশদভাবে কোনো বই লিখছি না, আমি কেবল তাঁর কিছু খণ্ড মুহূর্তওই রাতের ওই বিশেষ মুহূর্তটি তুলে ধরতে যা দরকার,  তাই লিখছি এটা হয়ে উঠেছে ফেব্রুয়ারির হুল ফুটানো ঠান্ডা রাতে সন্তানহারা এক পিতার মনোজগতের কড়চা।

প্রশ্নঃ সর্ম্পূণ উপন্যাসটি লেখা হয়েছে ব্লক কোটেশনে, কেন? 
জর্জ স্যান্ডার্স: আমার এক গুণী ছাত্র, অ্যাডাম লেভিন একবার আমাকে ই-মেইলে বলল, সে ভাবছে, আমি যদি কখনো উপন্যাস লেখতাম, সেটা হয়তো টানা লেখা হতো। তার কথায় আমার অভিব্যক্তি ছিল এমন: ওহ্, মজার তো! এবং একই সঙ্গে আমি চেষ্টা করছিলাম বিরক্তিকর বিষয়গুলো এড়িয়ে চলার। যেমন, আমার ইচ্ছা ছিল না ৩০০ পৃষ্ঠার লিংকন মনোলগ লেখার। এবং সরল-সোজা বর্ণনামূলক শৈলী, যেমন: 'এক ঘন অন্ধকার রাতে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন সকলের অলক্ষ্যে অন্ধকারের চাদরে মোড়ানো সমাধিস্থলে প্রবেশ করল।' এ ধরনের সূচনাকে মনে হলো বিরক্তিকর।

অনেক লেখা আছে যা ভেতরে-ভেতরে বিরক্তিসূচক বিষয় থেকে আপনাকে সরিয়ে নেবে। এ ধরনের লেখার ভালো কৌশল হলো রঙ্গ-তামাশার দিকে ঝুঁকে পড়া। আর এ উপন্যাসের ক্ষেত্র আমি ‘আহা অনুভূতি পেলাম এই ভেবে যে আমি যদি ভূতের সঙ্গে সমান্তরালভাবে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটকে দাঁড় করাতে পারি তাহলে ঘটা করে কোনো তামাশা সৃষ্টি না করেও এ দুটোর মধ্য দিয়ে গল্পটা বলে যেতে পারব আমি।

প্রশ্নঃ বিজ্ঞান কল্পকাহিনি ও উদ্ভট ঘটনাকে বাস্তববাদী গল্প বা উপন্যাসে ব্যবহার করার জন্য ‘স্লিপস্ট্রিম (কল্পকাহিনি, রোমান্স কাহিনি এবং বাস্তবাদিতার মিশ্র শৈলী) লেখক বলা হয় আপনাকে। বাস্তবতা কি এ ধরনের পাগলাটে বাস্তববাদের ভেতর দিয়ে নির্ণয় করা যায়?

জর্জ স্যান্ডার্স:  আমি এ ধরনের ঘটনা বা উপকরণ ব্যবহার করি একটি বাস্তব ঘটনার ভাবোদ্দীপক সত্যের ভেতর মধু সঞ্চার করতে। যখন আমি নিজের জীবনের দিকে ফিরে তাকিয়ে দেখি আমার জীবনটা আসলে কেমন ছিলযেটা আক্ষরিকভাবে ঘটেছে, সেটা তুলে ধরতে আমি যে আবেগঘন মুহূর্তের ভেতর দিয়ে গেছি, সেটাকে কমিয়ে আনতে হয়েছে। অন্যভাবে বলতে হয়, জীবনের সোজাসুজি বাস্তবধর্মী বয়নরীতি অনেক কিছু কঠিন করে তোলে, এমনকি আমার মতো তুলনামূলক মধ্যবিত্ত জীবনকেও। নিজেকে আমি আসলে গোগলীয় বলে মনে করি, চেষ্টা করি জীবন কেমন অনুভূত হয় সেটা বুঝতে; তবে সেটা অনুভব করতে হলে আমাদের কিছুটা দুরন্তভাবে দোলাতে হবে। কারণ, জীবন প্রকৃতিগতভাবেই যেমন সুন্দর তেমন অপ্রকৃতিস্থ।

টাইম, ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৭।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন- সারা বেগেলে


Wednesday, October 25, 2017

গি দ্য মোপাসাঁ

গি দ্য মোপাসাঁ

গি দ্য মোপাসা: Guy de Maupassant (5 ই আগষ্ট, 1850-6 জুলাই, 1893) (একজন বিখ্যাত ফরাসি কবি গল্পকার ও ঔপন্যাসিক। 

জন্ম ১৮৫০ সালে ফ্রান্সের নরম্যান্ডিতে। জন্মসূত্রে তারা নর্মাণ। তার বার বছর বয়সের সময় পিতা মাতার বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে যায়। মায়ের কাছেই তার বাল্য শিক্ষা সমাপ্ত হয়। মায়ের কাছে তিনি শেকসপিয়রের অনুবাদ পড়েছিলেন। রুইয়েন এর উচ্চ বিদ্যালয়ে লেখাপড়া সমাপ্ত করেন। ঐ বিদ্যালয়ের এক সাহিত্যরসিক শিক্ষাক বোলহেতের কাছে মোপাসা সাহিত্যরসভোগ দিক্ষিত হন। এরপর ফ্রঙ্কো-প্রুশিয়ার যুদ্ধে তরুন মোপাসা যোগদান করেন। যুদ্ধের অভিজ্ঞতা গল্প ও উপন্যাস রচনায় তাকে বিশেষ সাহায্য করেছিল। এরপর ১৮৭২ থেকে ১৮৮০ সাল পর্যন্ত তিনি সিভিল সার্ভেন্ট হিসেবে ফ্রান্সের নৌ মন্ত্রণালয় ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে কাজ করেন। 

স্বল্পভাষী লাজুক স্বভাবের ছিলেন। মায়ের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য অনেকখানিই প্রভাব ফেলেছিল তার উপর। মা ভুগতেন দুরারোগ্য ব্যাধি ম্যালানকোলিয়ায়। 

গুস্তাভ ফ্লবেয়ার, এমিল জোলা, আলফস দোঁদে-দের উত্তরসূরী হিসেবে ১৮৮০ সালে একটি কাব্যগ্রন্থ(De Ver) প্রকাশের মধ্যে দিয়ে তাঁর সাহিত্যজগতে পদার্পণ। প্রথম কাব্যগ্রন্থে খুব বেশি জনপ্রিয়তা পাননি। এসময় প্যারিস তরুণ সাহিত্যিকদল একটি সাহিত্যিকদল বের করে একটি সাহিত্যিক সঙ্কলন। নাম Less Sovress de Medan। এখানে মোপাসাঁর প্রথম বড় গল্প 'ব্যুল দ্য সুইফ' (Boule de Suif)- ফ্রাঙ্কো-প্রুশিয়ান যুদ্ধের পটভুমিতে একজন বেশ্যার কাহিনী। ১৮৮৩ সালে আরেকটি বিখ্যাত গল্প প্রকাশিত হল, মাদমোয়াজেল ফিফি। এরপর প্রথম উপন্যাস Un-rie। উপন্যাসটি সরকারি রোষানলের শিকার হল। ১৮৮৫ সালে রচনা করেন বিখ্যাত উপন্যাস "বেল আমি"। 

মাত্র এক দশক সাহিত্যচর্চার সুযোগ পান মোপাসঁ, এই সংক্ষিপ্ত সময়ে তিনি তিনশ' ছোট গল্প, ছয়টি উপন্যাস, বেশ কিছু কবিতা এবং তিনটি ভ্রমণকাহিনী লেখেন। দুর্ভাগ্যবশত তারুণ্যের শুরুতেই তিনি সিফিলিস রোগে আক্রান্ত হন, যা তাঁকে ধীরে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে তোলে। শেষে মারাত্মক মানসিক বৈকল্যের শিকার হয়ে ১৮৯২ সালের ২ জানুয়ারি কন্ঠনালী কেটে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। পরে গুরুতর আহত অবস্থায় তাঁকে প্যারিসের একটি প্রাইভেট অ্যাসাইলামে ভর্তি করা হয়, এবং সেখানেই পরের বছর অর্থাৎ ১৮৯৩ সালের ৬ই জুলাই, মাত্র ৪৩ বছর বয়সে, মৃত্যুবরণ করেন এই প্রতিভাবান সাহিত্যিক। 

রবিন্দ্রনাথকে বাদ দিলে প্রায় তাবৎ বাঙ্গালী লেখকের উপর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মোপাসার প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছে। যাকে ছোট গল্প বলে, অর্থ্যাৎ এক বিশেষ ধরনের আঙ্গিকের আধারে মানুষের জীবন, কাহিনী, চরিত্র ও চিন্তার একাংশ লেখকের মায়ামুকুরে যে বিচিত্র বর্ণালী সৃষ্টি করে, তার জট বহু দূরে ব্যাপ্ত হলেও ইউরোপের উনবিংশ শতাব্দীর আগে তার কলারূপ পূর্ণতা লাভ করেনি। আমাদের দেশে রবীন্দনাথের পূর্বে কেউ ছোটগল্পের নব পরিপ্রেক্ষিত ও কলাকৌশল সম্মন্ধ্যে সচেতন ছিলেন না। গী দ্যা মোপাসার জীবনকথা বিচিত্র কিন্তু বিশাল না। আনন্দোজ্বল হলেও বিষন্নতা ও নৈরাশ্যের কুহেলিকায় আচ্ছন্ন। মানসিক সংবেগের দিক থেকে তিনি অতিশয় হৃদ্য ও বলিষ্ঠ, যা অনেক সময় বেপরোয়া ধৃষ্টতা বলেই মনে হবে। আবার অপরদিকে তিনি মনের সুস্থ্যতা ও ভারসাম্য হারিয়ে বেশ কিছুদিন পাগলাগারদে অবস্থান করেছিলেন। এইভাবে বিপরীতে, বিষম্যে, কান্না হাসিতে তার সমগ্র চেতনা আবিষ্ট।

Sunday, October 15, 2017

পাবলো পিকাসো ও গিওম আপোলিনেয়ার এর বন্ধত্ব

পাবলো পিকাসো ও গিওম আপোলিনেয়ার এর বন্ধত্ব

পাবলো পিকাসো ও গিওম আপোলিনেয়ার 
পাবলো পিকাসো ও গিওম আপোলিনেয়ার
তাঁরা ছিলেন পরস্পরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ফরাসি শিল্পী পাবলো পিকাসো ও কবি গিওম আপোলিনেয়ার। তাঁদের প্রথম দেখা ১৯০৫ সালে। স্বল্পায়ু গিওমের মৃত্যু হয় ১৯১৮ সালে, কিন্তু পিকাসো পেয়েছেন দীর্ঘ জীবন। পিকাসো গিওমের বইয়ের প্রচ্ছদ এঁকে দিয়েছেন, তাঁর প্রতিকৃতি করেছেন। এ
কই সঙ্গে পিকাসো ও গিওম একটি চিঠি পড়ছেন—এমন একটি ছবি এঁকেছেন তিনি ১৯২১ সালে। সারা জীবন বারবার তিনি মনে করেছেন বন্ধু গিওমের কথা। ১৯১০-এর দশকে গিওম ছিলেন প্যারিসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিত্র ও কাব্যসমালোচক। পিকাসোকে আরও বড় করে তুলে ধরতে বিভিন্নভাবে প্রচারণা চালিয়েছেন তিনি। একবারই শুধু ঝামেলায় ফেলে দিয়েছিলেন পিকাসোকে।
২১ আগস্ট ১৯১১। ল্যুভ মিউজিয়াম থেকে চুরি হয়ে যায় লিওনার্দো দা ভিঞ্চির বিখ্যাত চিত্রকর্ম 'মোনালিসা'। পরদিন শিল্পী লুই বেরুদ মিউজিয়ামে গিয়ে দেখলেন, পাঁচ বছর ধরে 'মোনালিসা' যেখানে শোভা পাচ্ছিল, সেখানে দেয়ালে কেবল চারটি পেরেক, শিল্পজগতের সবচেয়ে আলোচিত এই নারী নেই। প্রথমে মনে করা হলো, ল্যুভের কোনো বিজ্ঞাপনী প্রয়োজনে ছবি তুলতে হয়তো 'মোনালিসা'কে অন্য কোথাও সরানো হয়েছে; কিন্তু দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এমন কিছু ঘটেনি বলে জানালেন। অর্থাৎ 'মোনালিসা' চুরি হয়ে গেছে। গোটা সপ্তাহের জন্য বন্ধ হয়ে গেল ল্যুভ মিউজিয়াম। 

আপোলিনেয়ার একবার ল্যুভ পুড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়েছিলেন। সুতরাং পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করল, জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুরল কারাগারে। গিউম পুলিশি প্রশ্নের মুখোমুখি শিল্পী পাবলো পিকাসোর নাম বলে দিলেন। গ্রেপ্তার হলেন তিনিও। অবশ্য চুরির সঙ্গে তাঁদের কারোরই কোনো যোগসূত্র না পাওয়ায় একসময় ছেড়ে দেওয়া হয় দুজনকেই। উদ্ধারকৃত 'মোনালিসা' ৪ জানুয়ারি ১৯১৪ ল্যুভে ফিরে আসে। 

গিওমের মৃত্যুর ৩০ বছর পূর্তিতে পিকাসো আবার তাঁকে স্মৃতি থেকে এঁকে ছিলেন। গিওমকে এঁকেছেন অঁরি রুশো, মাতিসে, মার্ক শাগাল, মিখাইল লারিনোভ, জুয়ান গ্রিস, জ্যা ম্যাটজিঞ্জার, মার্সেল জর্জিও চিরিকো এবং অভিন্নহৃদয় বন্ধু পিকাসো তো বটেই।

Thursday, October 12, 2017

Henry James

Henry James

Henry James 

Henry James/td>
হেনরি জেমস নিউ ইয়র্কের ওয়াশিংটন প্লেসে 1843 সালের 15 ই এপ্রিল জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা হেনরি জেমস স্যার ছিলেন একজন উজ্জ্বল ও অদ্ভুত ধর্মীয় দার্শনিক। তার ভাই ছিলেন প্রথম গ্রেট আমেরিকান মনোবিজ্ঞানী এবং প্রভাবশালী প্রগতিবাদী লেখক; তার বোন অ্যালিস যদিও তার বেশিরভাগ জীবনের জন্য নিষিদ্ধ ছিলেন, একজন প্রতিভাধর কথোপকথক ছিলেন, একজন প্রাণবন্ত চিঠি লেখক, এবং তার সময়ের শিল্প ও রাজনীতির এক বিস্ময়কর পর্যবেক্ষক ছিলেন। তার শিশুদের জন্য যথাযথ শিক্ষার অনুসন্ধানে, হেনরি সিনিয়ররা আমেরিকা, ফ্রান্স, জার্মানি এবং সুইজারল্যান্ডের স্কুলে পাঠিয়েছিলেন। আমেরিকা ফিরে আসেন, হেনরি জুনিয়র নিউপোর্টে বসবাস করতেন, সংক্ষিপ্তভাবে হার্ভার্ড ল স্কুলে যোগদান করেন, এবং 1864 সালে পত্রিকাগুলিতে গল্প এবং বই পর্যালোচনাগুলিতে অবদান রাখতে শুরু করেন। ইউরোপে আরও দু'বার ভ্রমণের ফলে তার সিদ্ধান্ত স্থগিত করার সিদ্ধান্ত নেয়, প্রথমে 1875 সালে প্যারিসে, তারপর লন্ডনে পরবর্তী বছর। জেমস এর প্রথম প্রধান উপন্যাস, Roderick Hudson, 1875 সালে প্রকাশ, কিন্তু ডেজি মিলার (1878) ছিল যা আমেরিকান প্রবাসীদের ইতিহাসবিদ এবং তাদের ইউরোপীয় ইভেন্টস হিসাবে আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করেছিল। তাঁর উপন্যাসটি হল দ্য আমেরিকান (1877), ওয়াশিংটন স্কোয়ার (1880), রাজকুমারী কাসাম্যাসিমা (1886) এবং তিনটি দ্য মাস্টারপিসেস, দ্য উইংস অফ দি ডাভ (190২), দ্য অ্যাঙ্গাসেটরস (1903) এবং দ্য গোল্ডেন বোল (1904)। তিনি নাটক, সমালোচনা, আত্মজীবনী, ভ্রমণের বই (দ্য আমেরিকান দৃশ্য, 1907 সহ) এবং ইংরেজিতে শেখার কয়েকটি সংক্ষিপ্ত কাহিনী রচনা করেছেন। তাঁর পরবর্তী কাজগুলি তাঁর জীবদ্দশায় খুব সামান্যই প্রভাব পড়েছিল। কিন্তু পরে থেকে সাহিত্যিক আধুনিকতাবাদের অগ্রদূত হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রাদুর্ভাবের পর, জেমস তাঁর শক্তিগুলিকে যুদ্ধের ত্রাণ কাজে নিক্ষেপ করেন এবং ব্রিটিশ নাগরিকত্ব গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন। 1916 সালে তার মৃত্যুর এক মাস আগে তিনি কিং জর্জ ভের কাছ থেকে অর্ডার অফ মেরিট পেয়েছিলেন।

The wings of the dove
লন্ডনের ডাইনিং রুম এবং সোনাবীণ ভিনিস্বাসী প্যালাজোসের মহিমান্বিতে, দ্য উইংস অফ দ্য ডাভ হল মিলি থেইল, একজন ভদ্রলোক, বিস্মৃত আমেরিকান পত্নী এবং প্রেমিকা, কেট ক্রয় এবং মর্টন ডেনশারের একটি কাহিনী; আত্ম-প্রতারণা এবং বিশ্বাসঘাতকতার একটি বিদ্বেষপূর্ণ বিয়োগান্ত নাটক, হেনরি জেমস একসাথে তিনটি অপ্রতুল এবং পূর্ণ মানব ভাগ্য অপ্রত্যাশিতভাবে ইচ্ছা, লোভ এবং পরিত্রাণের দ্বারা সংযুক্ত। এমি ব্লুম তার ভূমিকাতে লিখেছেন, "দ্য উইংস অব ডাব" অন্তরঙ্গতার একটি উপন্যাস। “জেমস আমাদের আবেগ দেয়, তিনি আমাদেরকে তার ভয়ঙ্কর এবং আকর্ষণীয় রূপে ভালবাসে। "

Download link here for free pdf

Sunday, September 24, 2017

থ্রিলার আউটলাইন

থ্রিলার আউটলাইন

বিশ্বসাহিত্যে থ্রিলারের জনপ্রিয়তা নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই প্রকাশনা শিল্পের সবচেয়ে জনপ্রিয় আর পাঠকপ্রিয় এইজনরাবা ধারাটি নিয়মিত পাঠকদের বিরাট অংশ থ্রিলার গল্প-উপন্যাস পড়ে থাকেন আমাদের দেশেও প্রচুর পাঠক আছেন, যাঁরা ধরনের লেখা পড়তে পছন্দ করেন, পড়ে বিনোদিত হন ইদানীং অনেকেই ধরনের লেখার দিকে ঝুঁকে পড়ছেন প্রতিবছর এই সংখ্যা বেড়ে দ্বিগুণও হচ্ছে যেহেতু অন্য লেখার চেয়ে ধরনের লেখা একটু ভিন্নধর্মী, তাই এর জন্য দরকার একটু ভিন্নধর্মী প্রক্রিয়া বিশ্বের বেশির ভাগ থ্রিলার লেখকই সাধারণ কিছু নিয়ম অনুসরণ করে থাকেন নিয়মগুলো এমন কঠিন কিছু নয়

অন্যান্য গল্পের চেয়ে থ্রিলার গল্পগুলোর প্লট আলাদা, তাই এর গঠনপ্রণালিও ভিন্ন থ্রিলার হলো ডার্ক সাইড অব দি মুনজীবনের অন্ধকারাচ্ছন্ন গল্পগুলোই উঠে আসে এখানে অন্যসব গল্পের মতো এখানেও প্রেম-ভালোবাসা, মানবিক সম্পর্কের টানাপোড়েন থাকে, তবে সেই সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে থাকে মানবিক ত্রুটি, খুন, ষড়যন্ত্র আর রহস্য আর এটাই থ্রিলারের মূল উপজীব্য পাঠককে গল্পটা এমনভাবে জানাতে হয় যেন তাঁরা রোমাঞ্চিত হন, রহস্যের গন্ধ পান, বাধ্য হন শেষ পৃষ্ঠা পর্যন্ত পড়তে
প্রথমেই আসে প্লটের কথা, যে প্লট ঘিরে আবর্তিত হবে গল্পটি এই প্লট আপনি পেতে পারেন বর্তমান আর অতীতের কোনো বাস্তবিক ঘটনা, পুরাণ, মিথলজি, রূপকথা আর মহাকাব্য থেকে পত্রিকার প্রতিবেদন বা রিপোর্টিং থ্রিলার গল্পের প্লটের দারুণ একটি উৎস গান, কবিতাসহ প্রায় সবকিছু থেকেই প্লট নেওয়া যেতে পারে রকম কোনো কিছুর সঙ্গে নিজের কল্পনা মিশিয়ে লেখক দাঁড় করিয়ে নিতে পারেন তাঁর প্লট বাস্তবের সঙ্গে যত বেশি কল্পনা মেশানো হবে, ততই ভালো একটি ভালো ফিকশনে কল্পনার পরিমাণই বেশি থাকে
বিশাল ষড়যন্ত্র আর দুনিয়া কাঁপানো প্লটের চিন্তা পরিহার করা জরুরি দুর্বল লেখকই এমন প্লটের দিকে বেশি আকর্ষিত হন একটা বিষয় মনে রাখা দরকার, প্লট হচ্ছে বীজের মতো ভালো বীজই যেমন শেষ কথা নয়, তেমনি ভালো প্লটও ভালো গল্পের একমাত্র উপাদান হতে পারে না আপনার লেখনী ক্ষমতাই প্লটকে আকর্ষণীয় করে তুলবে
একটি প্লটকে গল্পে রূপান্তর করতে হয়, আর সেই গল্পকে এগিয়ে নিয়ে যায় ছোট-বড় কিছু চরিত্র সেসব চরিত্রের মধ্যে মুখ্য চরিত্র থাকে এক বা একাধিক শক্তিশালী মুখ্য চরিত্র না থাকলে গল্পটি এগিয়ে যেতে পারে না মুখ্য চরিত্র সংখ্যায় বেশি না হওয়াই ভালো পার্শ্বচরিত্রগুলো যেন বিরক্তিকর না হয়, সেদিকেও খেয়াল রাখা দরকার
গল্প চূড়ান্ত করার পর আউটলাইন করা অত্যন্ত জরুরি লেখক গল্পটি কীভাবে লিখবেন সেটা আগে ঠিক করে নিতে হয় কেউ কেউ ভেবে থাকেন, গল্পের আউটলাইন করা মানে সৃজনশীলতার গায়ে স্ট্রেইট জ্যাকেট পরিয়ে তার হাত-পা বেঁধে ফেলা আদতে আউটলাইন বরং উল্টোটা করে এটা লেখকের সৃষ্টিশীলতাকে সঠিকভাবে প্রকাশের সুযোগ করে দেয় ভালো আউটলাইন গল্প লেখার মেরুদণ্ড হিসেবে কাজ করে আউটলাইন ছাড়া থ্রিলার গল্প লেখা হয়তো যায়, কখনো কখনো কোনো কোনো লেখক হয়তো সেটা করতেও পারেন কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আউটলাইন ছাড়া ভুল পথে এগোতে শুরু করে গল্পটি মাঝখানে গিয়ে লেখক খেই হারিয়ে ফেলেন গল্পের শুরু, বিস্তার আর শেষটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ আউটলাইন কাজগুলো ভালোমতো করতে সাহায্য করে লেখকের পরিষ্কার ধারণা থাকে তাঁর গল্পটা কীভাবে এগোবে আউটলাইন না করলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই শেষটায় গিয়ে ঝামেলায় পড়তে হয় খুব ভালো সমাপ্তি দেওয়াও সম্ভব হয় না গল্পের সমাপ্তি যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি কাজটা করাও কঠিন এটা অনেকটা প্লেন ল্যান্ড করার মতোই
থ্রিলারের অনেক জনরা আছে, কোন জনরাতে লিখবেন, সেটা আগে থেকে ঠিক করে নেওয়াও জরুরি সুতরাং জনরাগুলো সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা থাকা বাঞ্ছনীয় এমন নয় যে, আপনার প্লট কিংবা চরিত্র নির্ধারণ করে দেবে গল্পটি কোন জনরার সত্যি বলতে, গল্প বলার ধরনই জনরা নির্ধারণ করে দেয় খুনের গল্প হলেই সেটা থ্রিলার জনরার মধ্যে পড়বে না, আপনি সেটা কীভাবে লিখছেন, তার ওপরই নির্ভর করছে এটিমার্ডারযেকোনো গল্পে থাকতে পারে কিন্তুমিস্ট্রিযোগ হলেই সেটামার্ডার-মিস্ট্রিহয় আপনি খুনের রহস্য উন্মোচন করাতে পারেন, অর্থাৎ খুনটা কে করল আবার খুনটা কীভাবে হলো, সেটাও দেখাতে পারেন
যা- হোক, আপনার কাছে একটি প্লট আছে আপনি নিশ্চিত এটা নিয়েই লিখবেন কিছু চরিত্রও আপনি কল্পনা করে নিয়েছেন গল্পটির আউটলাইনও করে ফেলেছেনকোনটার পর কোনটা আসবে, ঘটনাগুলো পর্যায়ক্রমে কীভাবে ঘটবে, চরিত্রগুলো কীভাবে উপস্থিত হবে
আউটলাইন করার সময় আরেকটি বিষয় মাথায় রাখা জরুরিশুরুতেইকনফ্লিক্টকিংবাঅ্যাকশনদেখানোটাই ভালো তারপর প্রধান চরিত্রকে হুট করে সেইকনফ্লিক্ট-অ্যাকশনেটেনে না এনে তার প্রাত্যহিক জীবনের কিছু খণ্ডচিত্র দেখানো যেতে পারে চরিত্রটাকে মানবিক হিসেবে দেখানো, সেই সঙ্গে তার রূপান্তর ঘটানোর জন্য এটার দরকার রয়েছেকনফ্লিক্ট-অ্যাকশন’-এর যে পরিস্থিতি, সেটার পরিবর্তনের সুযোগ রাখা দরকার গল্পে তারপর ঘটনা যেনপয়েন্ট অব নো রিটার্ন’- চলে যায়, সেটা দেখানো যেতে পারে নতুন পরিস্থিতির উদ্ভবও দেখানো যায় এরপর তবে গল্পে অবশ্যইডিভিয়েশনথাকতে হবে পাঠকের মনোযোগ ভিন্ন দিকে সরানোর জন্য এটার ভূমিকা অপরিহার্য জাদুকরদের মতো থ্রিলার লেখককেও কাজটা করতে হয় চরিত্রগুলোর ভেতরে টানাপোড়েন সৃষ্টি করা, ক্রাইসিসটাকে চূড়ান্ত অবস্থায় নিয়ে যাওয়া, প্রধান চরিত্রের হতাশা, সমস্যার সমাধান প্রায় অসম্ভব দেখানো, অবশেষে ফাইনাল শো-ডাউন, আর তারপরই পরিসমাপ্তি
ঘন ঘন টুইস্ট দেওয়ার বাতিক থাকে নতুন লেখকদের এই প্রলোভন থেকে নিজেকে দূরে রাখাটা খুব জরুরি ক্ষেত্রেম্যাজিক বুলেটথিওরির প্রয়োগ করা যেতে পারে মোক্ষম একটি টুইস্টই যথেষ্ট
মনে রাখবেন, আউটলাইন করা অনেকটা কোনো ভবনের নকশা করার মতো এটা গল্পের ডায়াগ্রাম হিসেবে কাজ করবে আপনার আউটলাইন যত ডিটেইল হবে, লিখতে ততটাই সুবিধা পাবেন ডিটেইল আউটলাইন করতে হয় সময় নিয়ে মূল গল্পটা মাথায় রেখে দিনের পর দিন ভেবে যাওয়া, ছোট ছোট ডিটেইল, ক্লু, টুইস্ট, সারপ্রাইজ টুকে রাখা, দরকার পড়লে চরিত্রগুলোর সংলাপও মাথায় চলে এলে লিখে রাখা যায় সৃষ্টিশীল কাজগুলোর আসল উৎস স্ট্রিম অব কনসাসনেস যখন যেটা মাথায় আসবে, টুকে রাখা তাই জরুরি হাতের কাছে কাগজ না থাকলে সঙ্গে থাকা মুঠোফোনে রেকর্ড করে নেওয়া যেতে পারে, নইলে খুব দ্রুতই হারিয়ে যাবে এসব
যে বিষয়টা নিয়ে লিখছেন, সে সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকতে হবে এখানে ঘাটতি থাকলে কিছুটা পড়াশোনা করে নেওয়া দরকার অনেক সময় থ্রিলার লিখতে গেলে প্রচুর গবেষণার দরকার পড়ে, এটা অবশ্য অন্য সব লেখার বেলায়ও প্রযোজ্য গুগল, উইকিপিডিয়া আর ইন্টারনেটের যুগে খুব সহজেই গবেষণার কাজটা করা যেতে পারে হয়তো অনেক গবেষণা করে অনেক কিছু জেনে গেলেন, স্বভাবতই চাইবেন সেগুলো লেখার মধ্যে ঢুকিয়ে দিতে ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হয় গবেষণার খুব কম অংশই ব্যবহার করা বাঞ্ছনীয় আপনি অনেক জানেন, এটা বোঝানোর দরকার নেই পাঠককে; বরং আপনি কত সুন্দরভাবে গল্পটা বললেন, সেদিকে নজর দিন হিমশৈলীর বেশির ভাগ অংশই পানির নিচে থাকে, আপনার গবেষণারও বেশির ভাগ অংশ আপনার মাথায় থাকবে, লেখায় থাকবে তার সামান্যতম অংশ পাঠককে জ্ঞান দিচ্ছেন, উপদেশ খয়রাত করছেন, রকম প্রিচিং মনোভাব থেকে বিরত থাকুন শুধু নিজের গল্পটা বলুন সুন্দর করে, সাবলীল ভাষায় উপস্থাপন করুন সেটি যদি চান কিছুটা প্রিচিং করবেনই, কিছুটা জ্ঞান না দিয়ে পারছেন না, তবে সেটা প্রচ্ছন্নভাবে দিন নইলে Large Volume Error বলে যে কথাটা প্রচলিত আছে, সেটার চোরাবালিতে পড়ে যাবেন
ছোটগল্প আর নভেলা বাদে উপন্যাসের ক্ষেত্রে কিছু সাব-প্লটের দরকার হয় সেগুলো যে সব সময় মূল প্লটের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে, এমন নয় তবে খেয়াল রাখতে হয়, সাব-প্লট যেন চরিত্রগুলোর সঙ্গে অবশ্যই সম্পর্কিত থাকে চরিত্রগুলোকে প্রতিষ্ঠিত করতে সাহায্য করে, এমন সাব-প্লট পাঠকের কাছে বেশি গ্রহণযোগ্যতা পায় এক বা একাধিক সাব-প্লট আগে থেকে ঠিক করে নেওয়া ভালো অনেক সময় এগুলো লেখা শুরু করার পরও চলে আসতে পারে
চরিত্র-স্থান-প্লট, এগুলো আলাদা একটি ডায়াগ্রামে সাজিয়ে নিতে পারেন ইচ্ছে করলে এক্ষেত্রে দেখে নিতে পারেনথ্রিলারের আউটলাইনিশরোনামের ছকটি
আউটলাইন করার পর বসে পড়ুন ফরাসি লেখক অনরে দ্য বালজাক ছাড়া দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কেউ লেখেননি, লেখেনও না যা- হোক, একটি সাদা কাগজ কিংবা সাদা স্ক্রিন এখন আপনার সামনে মাথার মধ্যে গল্প, চরিত্র আর লেখা গিজগিজ করছে আউটলাইন বলে দিচ্ছে, কোনটার পর কোনটা লিখতে হবে ব্যস, লিখতে শুরু করে দিন এবার
শুরুটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ এক বা দুই পৃষ্ঠার মধ্যে গল্পটা শুরু করতে পারলে ভালো হয় নইলে মুখ্য চরিত্রটাকে পরিচিত করা যেতে পারে পাঠকের কাছে থ্রিলার উপন্যাসে একটি স্ট্যান্ডার্ড ফরমেট রয়েছে, বেশির ভাগ গল্পেই প্রথমে একটি সূচনা থাকে, তারপর কতগুলো অধ্যায়ে বিস্তৃত হয় গল্পটি শেষে থাকে একটি পরিসমাপ্তি তবে আপনি এটা অন্যভাবেও করতে পারেন প্রতিটি অধ্যায়ের আলাদা আলাদা নাম দিতে পারেন, ঘটনাগুলোর সময়ানুক্রমেও সাজিয়ে নিতে পারেন অধ্যায়ের বদলে পুরো কাহিনিটি একাধিক পর্বে বিভক্তও করা যেতে পারে এসবই করা হয় উত্তেজনা আর রোমাঞ্চ ধরে রাখতে, বাড়িয়ে তুলতে
অনেকটা লেখার পর হঠাৎ করে হয়তো অনুভব করলেন, যেভাবে পরিকল্পনা করেছিলেন সেভাবে এগোচ্ছে না; গল্পটা অন্যদিকে মোড় নিয়ে ফেলেছে; যে চরিত্রগুলো কল্পনা করেছেন তার বাইরেও কিছু চরিত্রের আবির্ভাব ঘটছে আবার ঠিক করে রাখা কিছু চরিত্র হারিয়ে গেছে গল্প থেকে রকম পরিস্থিতিতে পড়লে বিচলিত না হয়ে বরং খুশি হওয়া উচিত জেনে রাখবেন, রকম ঘটনা কেবল তখনই ঘটে, যখন লেখাটা দাঁড়িয়ে যায়, গল্পটি জীবন্ত হয়ে ওঠে রকমঅপ্রত্যাশিত চরিত্রমোটেও অযাচিত নয় অনেক সময় এগুলোই হয়ে উঠতে পারে গল্পটির অন্যতম শক্তিশালী, আগ্রহোদ্দীপক কিংবা কেন্দ্রীয় চরিত্র
চরিত্রের কথা যখন উঠল, তখন আরেকটি বিষয় না বললেই নয় আপনার প্রধান চরিত্রটি অবশ্যই হতে হবে আকর্ষণীয় গ্ল্যামার অর্থে নয়; বরং আগ্রহোদ্দীপক, মজার, শক্তিশালী ব্যক্তিত্ব কিংবা নাছোড়বান্দা হিসেবে প্রধান চরিত্র অর্থাৎ প্রোটাগনিস্ট ছাড়াও পার্শ্বচরিত্রগুলোকে আকর্ষণীয় করলে গল্পটি যেমন প্রাণবন্ত হয়, তেমনি লেখায়ও আসে বৈচিত্র্য
আপনার লেখা যখন শেষ হবে, তখনই শুরু হবে আসল কাজ এটা অনেকটা ভিজ্যুয়াল মিডিয়া কিংবা চলচ্চিত্রের পোস্ট-প্রোডাকশনের মতো নিজের লেখাটা পড়ুন বারবার, অসংখ্য ভুল আর অসংগতি চোখে পড়বেবানান বিভ্রাটের মতো সাধারণ ভুল থেকে শুরু করে কাহিনির অসংগতি, প্লট হোল, সময়ের গোলমাল, চরিত্রগুলোর বিন্যাস, সংলাপ, সম্বোধনে সমস্যা, রিপিটেশন, স্ববিরোধিতা ইত্যাদি ছাড়াওস্পয়লারনামের বেফাঁস কিছু গল্পটার সব রহস্য আর কৌতূহল নষ্ট করে দিতে পারে এগুলো চিহ্নিত করে পরিমার্জন করতে হবে দরকার হলে কিছু অংশ আবার লিখতে হবে নিজের লেখা নির্মেদ করার ব্যাপারে একটু কঠোর হতেই হয় অপ্রয়োজনীয় মনে হলেই বাদ দিয়ে দিতে কার্পণ্য করা ঠিক হবে না প্রথম ড্রাফট অনেকটা খনি থেকে খুঁজে পাওয়া হিরের মতো ওটাকে কাটছাঁট করে পলিশ করতে হয় সম্ভব হলে, তিন-চারটা ড্রাফট করা যেতে পারে একাধিক ড্রাফটের পর নিজেই বুঝতে পারবেন, প্রকাশের জন্য আপনার লেখাটা উপযুক্ত হয়েছে কি না যদি হয়ে থাকে, তাহলে আপনাকে শুভেচ্ছা আর না হলে ভেঙে পড়ার কিছু নেই হাল ছেড়ে না দিয়ে আরও লিখতে শুরু করে দিন প্রচুর পড়ুন পড়ুন আর লিখুন মনে রাখবেন, ব্যর্থতা একটি পথ, যে পথের শেষে থাকে সফলতা
সবশেষে বলব, থ্রিলার গল্প লেখা অনেকটা নিজের সঙ্গে নিজে দাবা খেলার মতো তবে পার্থক্য হলো, এখানে সাদা-কালো ঘুঁটিগুলো জীবন্ত! কম-বেশি তাদেরও নিজস্ব কিছু সামর্থ্য রয়েছে আপনি চাইলেও সব সময় তাদের ইচ্ছেমতো পরিচালনা করতে পারবেন না কখনো কখনো তারাও আপনাকে বাধ্য করবে তাদের মতো করে চলতে সব ধরনের সৃষ্টির সঙ্গে স্রষ্টার সম্পর্ক হয়তো এমনই হয়
থ্রিলারের আউটলাইন
চরিত্র স্থান-কাল প্লট
প্রধান পার্শ্ব চরিত্রগুলো ঘটনাগুলোর স্থান সময়কাল প্লট সাব-প্লট