Thursday, November 2, 2017

দেবদাসনামা


শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (15 সেপ্টেম্বর, 1876  - 16 জানুয়ারী 1938)
উপন্যাস মধ্যবিত্ত সমাজের সৃষ্টি। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে বাংলার মধ্যবিত্ত শ্রেণি কলকাতা শহরের সংস্কৃতিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠতে শুরু করেছে। তখন গ্রামের জীবন ও সমাজ ছিল সামন্তপ্রথার শিকড়ে বাঁধা। এই ক্রান্তিকালে একের পর এক উপন্যাস লিখে যাওয়া ছিল অসম্ভব না হলেও কঠিন। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এই কঠিন কাজটি করে জনপ্রিয়তার শিখরে উঠেছিলেন। বিংশ শতকের যে সময় তিনি সাহিত্যচর্চা করেন, সেই সময় আর কেউ তাঁর মতো এত বিপুলসংখ্যক উপন্যাস লেখেননি। তাঁর সব উপন্যাসই পাঠকপ্রিয় হয়েছিল—এটাও বিস্ময়কর। বাঙালি উঠতি মধ্যবিত্ত শ্রেণির হৃদয় তিনি স্পর্শ করতে পেরেছিলেন তাঁর লিখনশৈলীর মাধ্যমে। শরৎচন্দ্রের দেবদাস উপন্যাসটি এর ব্যতিক্রমী কাহিনি ও অবিস্মরণীয় চরিত্রের জন্য লেখকের সমকালে এবং পরবর্তী সময়ে বাঙালির জীবনে বহুল আলোচিত শুধু নয়, বৈচিত্র্যের মাত্রাও যোগ করেছিল, যা তাঁর অন্য কোনো উপন্যাসের ক্ষেত্রে ঘটেনি। তাই এই উপন্যাস প্রকাশের শতবর্ষে দাঁড়িয়ে এখন এটা বলাই যায়, দিনে দিনে বাঙালি সংস্কৃতির অংশ হয়ে উঠেছে দেবদাস।


শরৎচন্দ্রের সব উপন্যাস মধ্যবিত্ত শ্রেণির পুরুষ ও নারী চরিত্র নিয়ে লেখা হলেও তাদের জীবনের প্রেক্ষাপটে ছিল আধা সামন্ততান্ত্রিক ও আধা পুঁজিবাদী সমাজের নানা টানাপোড়েন। গ্রামীণ জীবনের অচলায়তন এবং শহরে আংশিক মুক্ত জীবনযাপনের মধ্যে ছিল দ্বন্দ্ব-সংঘাত। শরৎচন্দ্রের উপন্যাসে নারী-পুরুষ চরিত্রের জীবনে যে জটিলতা ও সমস্যা, তার পেছনে প্রায় ক্ষেত্রেই কারণ হিসেবে ক্রিয়াশীল এই দ্বন্দ্ব-সংঘাত। সমাজই তাঁর প্রায় সব উপন্যাসে প্রধান পটভূমি। একমাত্র দেবদাস উপন্যাসেই তিনি সৃষ্টি করেছেন নায়ককেন্দ্রিক কাহিনি, যদিও এই নায়ক চরিত্র সমাজনিরপেক্ষ হয়ে স্বাধীনভাবে আচরণ করতে পারেনি। যে বৈশিষ্ট্যের কারণে জনপ্রিয়তার দিক দিয়ে দেবদাস শরৎচন্দ্রের অন্য উপন্যাসগুলোকে অতিক্রম করেছে, তা এর ট্র্যাজিক কাহিনি। তাঁর অন্য উপন্যাসে ট্র্যাজেডি এমন প্রাধান্য পায়নি। মূল চরিত্রের ট্র্যাজেডি বিশ্বাসযোগ্যভাবে আবেগের কাছে উপস্থাপনের কারণে দেবদাস সমকালে প্রবল জনপ্রিয়তার পাশাপাশি ধ্রুপদি উপন্যাসের মর্যাদাও লাভ করেছে। ধ্রুপদি সাহিত্যের আবেদন চিরকালের। দেবদাস যে ধ্রুপদি উপন্যাস, তার প্রমাণ এটি নিয়ে বিভিন্ন ভাষায় একের পর এক চলচ্চিত্র নির্মাণ এবং বইটি প্রকাশনার শতবর্ষে আবেগে-ভালোবাসায় স্মরণ।

দেবদাস-এর প্রতি কেন এই প্রায় নিরবচ্ছিন্ন আবেগ ও ভালোবাসা? প্রধান কারণ এর ট্র্যাজিক কাহিনি। দ্বিতীয় কারণ অনবদ্য ভঙ্গিতে সেই কাহিনির বর্ণনা। প্রাচীনকালে যখন সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছে, ট্র্যাজেডির সূচনা ছিল পুরোভাগে। গ্রিসে কমেডি রচয়িতা অ্যারিস্তোফেনিস ছাড়া আর সব নাট্যকার—যেমন এক্সিলাস, সফোক্লিস ও ইউরিপিডিস ট্র্যাজিকধর্মী নাটক লিখে দর্শকদের আকর্ষণ করেছেন। এই আকর্ষণের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলা হয়েছে, দর্শকেরা নাটক দেখে তাদের মনে জমে থাকা আবেগকে মুক্ত (ক্যাথারসিস) করতে পেরে যতটা আনন্দ পায়, অন্য ধরনের নাটক দেখে সেই পরিমাণে নয়। অনেক পরে লিও তলস্তয় আর্টের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন, মানুষের আবেগ প্রকাশই আর্ট। কমেডিও মানুষের মন থেকে একধরনের আবেগকে মুক্ত করে আনে কিন্তু সেই আবেগের গভীরতা ট্র্যাজিক আবেগের সঙ্গে তুলনীয় নয়। ‘ক্যাথারসিসের অভিজ্ঞতার জন্যই পাঠক (দর্শক) দেবদাস উপন্যাসের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল—এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। অশ্রুপাত করে মনকে হালকা করার মতো দৈবিক প্রক্রিয়া দ্বিতীয়টি নেই। শুধু প্রেম-ভালোবাসায় ব্যর্থ হয়েই মানুষ ট্র্যাজিক অনুভূতির অভিজ্ঞতা লাভ করে না। তার জীবনে ট্র্যাজেডি নানাভাবে, বিভিন্নরূপে ঘটতে পারে। যার জন্য এর সঙ্গে কেউই অপরিচিত নয়। আবার ট্র্যাজেডি যখন অন্যের জীবনে ঘটে, সেই ঘটনা দেখে বা শুনে আবেগে আপ্লুত হয় স্বাভাবিক চরিত্রের মানুষেরা। বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসে সফলভাবে লেখা প্রায় সব ট্র্যাজিক কাহিনিই পাঠকের (দর্শকের) মনে এই প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পেরেছে। আধুনিক বাংলা সাহিত্যে দেবদাসই প্রথম উপন্যাস, যেখানে ট্র্যাজেডিই প্রধান উপজীব্য। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে শরৎচন্দ্রের অতুলনীয় লেখনীভঙ্গি। ফলে দেবদাস-এর ধ্রুপদি মর্যাদা লাভ ছিল অবধারিত। দেবদাস বিংশ শতকের প্রথম দিকে (১৯১৭-কে প্রকাশনাকাল মনে করে) অবিভক্ত বাংলায় গ্রামের এক জমিদারের দ্বিতীয় পুত্র। ছেলেবেলা থেকেই সে বেশ সরল, নির্মল চরিত্রের ও বৈষয়িক জ্ঞানশূন্য। গ্রামের স্কুলে পড়ার সময় তার সখ্য গড়ে উঠেছে তাদের প্রতিবেশী এক পরিবারের মেয়ে পার্বতীর সঙ্গে। পার্বতীর বাবা সাধারণ মানুষ, জমিদারের সমপর্যায়ের নন। জাতের দিক দিয়েও দেবদাসের পরিবার নিচের সারিতে। গ্রামে স্কুলের পড়া শেষ করার আগেই দেবদাসকে পাঠিয়ে দেওয়া হলো কলকাতায়। বয়স বেড়ে যৌবনে উপনীত হলে পার্বতীর পিতামহী দুজনের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক মনে রেখে দেবদাসের মায়ের কাছে ওদের বিয়ের প্রস্তাব দিলেন। স্ত্রীর কাছে এ কথা জানার পর ক্ষুব্ধ হলেন দেবদাসের বাবা। তিনি উচ্চবংশীয় জমিদার হয়ে সাধারণ-নীচু জাতের পরিবারের মেয়ের সঙ্গে ছেলের বিয়ে দেবেন না—এমনই তাঁর মনোভাব। অগত্যা মনঃক্ষুণ্ন হয়ে দেবদাস চলে যায় কলকাতায়। সেখান থেকে পার্বতীকে চিঠি লিখে সে জানায়, তাকে সঙ্গী করার জন্য মা-বাবার মনে কষ্ট দেওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। চিঠিটি কাজের লোককে দিয়ে পোস্ট করার পর দেবদাসের মনে অনুশোচনা দেখা দেয়। তার বিবেক তাকে ভর্ৎসনা করে। তাড়াতাড়ি ভুল সংশোধনের জন্য গ্রামে যায় সে। কিন্তু এর আগেই পার্বতী দেবদাসের লেখা মর্মঘাতী চিঠিটি পড়ে ফেলেছে। পুকুরঘাটে দেখা করে দেবদাস পার্বতীকে জানায়, তার মা-বাবাকে রাজি করাবে সে। কিন্তু এতে বাধ সাধে পার্বতী—আত্মমর্যাদা রক্ষায় কিছুটা উষ্মার সঙ্গে, কিছুটা অভিমানে দেবদাসের পরিবারের সমালোচনা করে নিজের অসম্মতি জানায় সে। অতঃপর হতাশ হয়ে দেবদাস ফিরে আসে কলকাতায়। একই মেসে থাকা চুনীলালের উৎসাহে নিজের দুঃখ ভোলার জন্য সে পতিতাপল্লিতে যেতে শুরু করে। সেখানে দেখা হয় চন্দ্রমুখীর সঙ্গে। বারবনিতা চন্দ্রমুখীকে প্রথমে ঘোরতর অপছন্দ হলেও মেয়েটির মধুর ব্যবহারে ক্রমে তার সঙ্গে পছন্দ-অপছন্দমিশ্রিত একধরনের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে দেবদাস।

কাহিনির শেষ পর্যায়ে দেখা যায়, চন্দ্রমুখীর সেবা-যত্নে পরিবৃত হয়েও বিরহব্যথা ভোলার উদ্দেশ্যে অনির্দিষ্ট গন্তব্যে ট্রেনযাত্রা করে দেবদাস। তত দিনে অতিরিক্ত মদ্যপানে গুরুতর অসুস্থ সে। যাত্রাকালে ট্রেন অনেক স্থানে থামে কিন্তু দেবদাস নামে না কোথাও। তার অসুস্থতা যখন চরমে পৌঁছায়, সেই সময় ট্রেন থামে পাণ্ডুয়া স্টেশনে। দেবদাসের মনে পড়ে, কাছেই মানিকপুর গ্রামে বিয়ে হয়েছে পার্বতীর। তার আরও মনে পড়ে, নিজের ওপর সব অভিমান-অভিযোগ ভুলে পার্বতী তাকে বলেছিল, দেবদাস যেন মানিকপুরে আসে, পার্বতী যেন তাকে সেবা করার সুযোগ পায়। দেবদাস ট্রেন থেকে নেমে গরুর গাড়িতে মানিকপুর গ্রামের উদ্দেশে যাত্রা করে। কিন্তু গন্তব্যে এসে যখন পৌঁছায়, তখন তার শেষনিশ্বাস ফেলার সময়। পার্বতীর সঙ্গে তার দেখা হয় না।

দেবদাসের জীবনের ট্র্যাজেডির পেছনে রয়েছে সামন্তপ্রথাভিত্তিক সমাজের মূল্যবোধ আর জাতিভেদ। কলকাতায় থেকে পড়াশোনা করলেও স্বাধীনচেতা হতে পারেনি সে। তাই তার বাবা যখন জমিদারি এবং উচ্চবর্ণের কথা বলে পার্বতীর সঙ্গে তার বিয়ের প্রস্তাব ঘৃণাভরে নাকচ করে দেন, দেবদাস প্রতিবাদের দিকে না গিয়ে উল্টো দিকে ফিরে যায়। এখানে সে নীরব প্রতিবাদের ঊর্ধ্বে উঠে বিদ্রোহী হতে পারে না। দেবদাস চরিত্রের ব্যর্থতা এখানেই—পার্বতীর ভালোবাসাকে প্রাধান্য দিয়ে মা-বাবার অমতে তাকে বিয়ে করতে পারে না সে। সামন্ত সমাজের মূল্যবোধের কাছে পরাজিত হয় তার ব্যক্তিগত ইচ্ছা-সাধ। কলকাতায় শিক্ষা লাভ করার পরও মধ্যবিত্তের যে প্রধান বৈশিষ্ট্য—ব্যক্তিগত স্বাধীনতাবোধ—দেবদাস তা অর্জন করতে পারেনি। কেননা, তার সামাজিক পর্যায়ক্রম ছিল সামন্তপ্রথার অচলায়তন।

সামন্তপ্রথা ও স্বীয় পরিবারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে নিজের ইচ্ছা পূরণ করতে না পারলেও দেবদাস শাস্তি দেয় এবং তা নিজেকেই। মদ্যপান করে সে এমন অসুস্থ হয়ে পড়ে যে তার পক্ষে বেঁচে থেকে স্বাভাবিক জীবনযাপন আর সম্ভব হয় না।

পার্বতীর সঙ্গে বিয়ে নিয়ে দেবদাসের চরিত্রে যে সিদ্ধান্তহীনতার পরিচয় পাওয়া যায়, তার সঙ্গে তুলনীয় উইলিয়াম শেক্‌সপিয়ারের হ্যামলেট চরিত্রের। ‘টু বি অর নট টু বি’র মতো তার মনেও দেখা দেয় সিদ্ধান্তহীনতা এবং আত্মসমর্পণের অসহায়তা। অ্যারিস্টটলসহ পরবর্তী সময়ে অনেকেই বলেছেন, একজন মানুষের জীবন ট্র্যাজিক হয়ে ওঠে তার চারিত্রিক ত্রুটি-বিচ্যুতির জন্য। এর পাশাপাশি ট্র্যাডেজির অন্য ব্যাখ্যাও আছে—বলা হয় ভুলের জন্যই ট্র্যাজেডি ঘটে। এই শেষের ব্যাখ্যাই যুক্তিসংগত মনে হয়। ত্রুটিপূর্ণ চরিত্র হলে একজনের জীবনে একের পর এক ট্র্যাজেডি ঘটতেই থাকবে। কিন্তু বাস্তবে তেমন হয় না, অন্তত গুরুতর আকারে নয়। বড় ট্র্যাজেডি একটাই ঘটে মানুষের জীবনে, যা হয়েছে দেবদাসের ক্ষেত্রে। এখানে তার চারিত্রিক দোষ-ত্রুটি কারণ হিসেবে কাজ করেনি, যেমন করেছে তার ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণ অথবা সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যর্থতায়। দেবদাসের মনে টানাপোড়েন। হ্যামলেটীয় সিদ্ধান্তহীনতা, এসব তার ভুলের জন্যই হয়। সামন্তপ্রথার প্রতিভূ তার জমিদার বাবার বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যর্থতাও এই ভুলের অন্তর্গত। অন্তর্দ্বন্দ্বে জর্জরিত বিরহকাতর দেবদাসের জীবনের করুণ পরিণতি পাষাণহৃদয় পাঠক-দর্শককেও বিষাদগ্রস্ত করে, তাদের অশ্রু নেমে আসে। ক্যাথারসিস সৃষ্টির এই সফলতাই দেবদাস উপন্যাসের জনপ্রিয়তার প্রধান কারণ।

দেবদাস উপন্যাসের কাহিনি নিয়ে বাংলা ও হিন্দিতে একাধিক চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও যে হবে, তাতে সন্দেহ নেই। কেননা, দেবদাসের কাহিনির আবেদন চিরন্তন। অবশ্য ভবিষ্যতের সেই সিনেমা এই কাহিনির প্রতি আর বিশ্বস্ত থাকবে বলে মনে হয় না।

দেবদাস-এর প্রথম সিনেমা-রূপান্তর হয়েছে ১৯২৮ সালে। এটি ছিল নির্বাক ছবি। এরপর ১৯৩৫ ও ’৩৬ সালে নির্মিত হলো আবার। এই দুটি অবশ্য সবাক। প্রথমটি বাংলায়, দ্বিতীয়টি হিন্দিতে। পরে ১৯৫৩-তে তামিল এবং ’৬৫-তে উর্দু ভাষায়ও নির্মিত হয়েছে দেবদাস।

অসংখ্য দেবদাস সিনেমার মধ্য থেকে বিখ্যাত দু-একটি কাহিনিচিত্র সম্পর্কে খানিকটা বলা যাক। প্রমথেশ বড়ুয়ার পরিচালনা এবং তাঁর ও যমুনার অভিনয়সমৃদ্ধ বাংলা ভাষার দেবদাস (১
৯৩৫) কিংবা বিমল রায় পরিচালিত দিলীপকুমার ও সুচিত্রা সেন অভিনীত হিন্দি দেবদাস-এর (১৯৫৫) চলচ্চিত্রায়ণ যতটা উপন্যাসানুগ, এর অনেক পরের ঐশ্বরিয়া রাই ও শাহরুখ খান অভিনীত সঞ্জয় লীলা বানসালির দেবদাস (২০০২) তেমন নয়। শুধু প্রমথেশ বড়ুয়া আর বিমল রায়ের শিল্পজ্ঞানভিত্তিক দক্ষ পরিচালনার জন্য নয়, সিনেমা তৈরির নান্দনিকতার কারণেও সাম্প্রতিককালে সঞ্জয় লীলা বানসালির দেবদাসের সঙ্গে আগের সিনেমাটির পার্থক্য আকাশ-পাতালের। প্রথম দুজন চেয়েছেন উপন্যাসের নান্দনিকতা ক্ষুণ্ন না করে শিল্প সৃষ্টি করতে আর শেষোক্ত পরিচালকের উদ্দেশ্য ছিল বাণিজ্যিক ফর্মুলা অনুযায়ী দর্শকের মনোরঞ্জন, বক্স অফিসের সাফল্যই যেন প্রধান বিবেচ্য। বানসালির দেবদাস কেবল রঙিন নয়, নাচে-গানে ভরপুর, যা বিনোদনের প্রয়োজন মেটায়, কিন্তু কতটা শিল্প সৃষ্টি করে তা প্রশ্নসাপেক্ষ। কাহিনি উপস্থাপনার ক্ষেত্রে ট্র্যাজেডিতে যে গাম্ভীর্য আর করুণ আবহ থাকে, বানসালির দেবদাস-এ সেটা জাঁকজমকপূর্ণ পরিবেশ ও উজ্জ্বল রঙের ভেতর হারিয়ে গেছে।

একই পরিণতি ঘটেছে ইংরেজি ভাষার ধ্রুপদি ট্র্যাজেডি এমিলি ব্রন্টের উদারিং হাইটস উপন্যাসের চলচ্চিত্রায়ণে। লরেন্স অলিভিয়ের ও মার্ল ওবেরন অভিনীত চলচ্চিত্রটির সঙ্গে এমটিভি প্রযোজিত উদারিং হাইটস-এর পার্থক্যও একই রকমের। প্রথমটিতে উপন্যাসের প্রতি নির্ভরতা যতটা মুখ্য, শেষেরটিতে মুক্তভঙ্গিতে কাহিনি নির্মাণ ও মূল উপন্যাস থেকে সরে আসার কারণে কাহিনির প্রতি বিশ্বস্ততা আর থাকেনি। এমটিভির চলচ্চিত্রটি পপ সংস্কৃতি অনুসরণে রক ও পপ সংগীত ব্যবহারের মাধ্যমে টিনএজদের বিনোদনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করেছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, এসব প্রচেষ্টা অবশ্যই নতুন প্রজন্মকে আকৃষ্ট করার জন্য। সময়ের পরিবর্তনে মানুষের রুচি বদলায়, কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে পরিচালক-প্রযোজক ধ্রুপদি কোনো সাহিত্যকর্ম বিকৃত করবেন কেবল দর্শকের মনোরঞ্জনের জন্য।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশে নির্মিত বুলবুল আহমেদ ও কবরী অভিনীত দেবদাস (১৯৮২) কাহিনির প্রতি বিশ্বস্ত থেকে চাষী নজরুল ইসলামের দক্ষ পরিচালনা এবং চরিত্র দুটিতে কুশলী অভিনয়ের জন্য বিশ্বাসযোগ্য হয়ে দর্শক-সমালোচক—উভয়েরই প্রশংসা অর্জন করেছে। মূলধারার বাণিজ্যিক ছবির গড্ডলিকা প্রবাহে সিনেমাটি বিসর্জিত হয়নি।

ট্র্যাজেডির কাহিনি মানুষের হৃদয়ের অন্তস্তলে গভীরতম ও বিষাদময় অনুভূতি স্পর্শ করে। এই অনুভূতি যেমন মানুষের ব্যর্থতার প্রতিনিধিত্ব করে, একই সঙ্গে প্রকাশ করে তার অপাপবিদ্ধতা ও মহত্ত্ব। এভাবে ট্র্যাজেডি একটি চরিত্রকে জীবনের চেয়ে বড় মাপের করে তোলে। এ কারণেই শরৎচন্দ্রের দেবদাস সর্বকালের মানুষের হৃদয়ের কাছে আবেদন রেখে কালজয়ী হয়েছে। শতবর্ষ পরও বইটি স্মরণীয় হয়ে থাকবে তার চিরন্তন মানবিক পরিচয়ের জন্য।
উত্তম কুমার ও সৌমিত্র চট্রোপাধ্যায়, কলকাতায় নির্মিত দেবদাস 1979

কবরী ও বুলবুল আহমেদ, বাংলাদেশে নির্মিত দেবদাস 1982

ঐশ্বরিয়া রাই ও শাহরুখ খান, বলিউডে নির্মিত দেবদাস, 2002

দেবদাসনামা

‘বোতল খাইয়া লেখা’

দেবদাস শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রথম জীবনের রচনা। কিশোর বয়সে তিনি যখন বিহারের ভাগলপুরের খঞ্জরপুর পল্লিতে থাকতেন, সে সময় লুকিয়ে উপন্যাসটি লেখা শুরু করেন। যদিও এ লেখা নিয়ে তিনি এক ধরনের দোলাচলে ভুগেছেন। ১৯১৩ সালের জুন মাসে বন্ধু প্রমথনাথ ভট্টাচার্যকে লেখা এক চিঠিতে দেবদাস বিষয়ে জানিয়েছিলেন, ‘শুধু যে ওটা আমার মাতাল হয়ে লেখা তাই নয়, ওটার জন্যে আমি নিজেও লজ্জিত।...’ একই বছরের ১৭ জুলাই প্রমথনাথকে লেখা আরেক চিঠিতে ওই বিষয়ে আরও বলেছেন, ‘ওই বইটা একেবারে মাতাল হইয়া বোতল খাইয়া লেখা।’

সূত্র: শরৎচন্দ্র, গোপালচন্দ্র রায়

প্রকাশের ইতিকথা

সম্ভবত বন্ধু ও প্রকাশকের তাগাদার কারণেই শরৎচন্দ্র পরে দেবদাস কিছুটা ঠিকঠাক করে ছাপার ব্যাপারে মনস্থির করেন। ভারতবর্ষ পত্রিকার ১৩২৩ বঙ্গাব্দের চৈত্র ও ১৩২৪-এর বৈশাখ-আষাঢ় সংখ্যায় উপন্যাসটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। ভারতবর্ষ গোষ্ঠীরই মালিকানাধীন প্রকাশনা সংস্থা গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় অ্যান্ড সন্স থেকে ১৯১৭ সালের জুন মাসের ৩০ তারিখে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় উপন্যাসটি। এ জন্য অগ্রিম পারিশ্রমিক হিসেবে লেখক পেয়েছিলেন দুই হাজার টাকা।

সূত্র: শরৎচন্দ্র, গোপালচন্দ্র রায়

চরিত্রের উৎস-সন্ধানে

হিন্দি ভাষায় শরৎ-জীবনীকার বিষ্ণু প্রভাকরের ধারণা, পার্বতী চরিত্রের মূলে রয়েছে শরৎচন্দ্রের বিদ্যালয়-জীবনের এক বান্ধবী ধীরু। তাঁর প্রতি শরতের মোহ ও ভালোবাসা খুব সহজে যায়নি। সেই ব্যর্থ প্রেমের স্মৃতিই তিনি পার্বতী চরিত্রে ধরে রাখার চেষ্টা করেছিলেন। চন্দ্রমুখীর চরিত্র আদতে কালিদাসী নামের এক বাস্তব নর্তকীর ওপর ভিত্তি করে রচিত। এক বন্ধুর সঙ্গে লেখক সেই নর্তকীর গান শুনতে গিয়েছিলেন। আর ধর্মদাসের চরিত্রটি গড়ে উঠেছে তাঁর মামার বাড়িতে দেখা এক সেবকমশাইকে কেন্দ্র করে। সূত্র: ছন্নছাড়া মহাপ্রাণ, বিষ্ণু প্রভাকর, অনুবাদ: দেবলীনা ব্যানার্জি কেজরিওয়াল

‘আসল’ পার্বতী!

পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার কালনার একটি গ্রাম হাতিপোতা। সেখানকার এলাকাবাসীর এখনো বিশ্বাস যে দেবদাস উপন্যাসের পার্বতী আসলে ছিলেন গ্রামের সাবেক জমিদার ভুবনমোহন চৌধুরীর দ্বিতীয় স্ত্রী! আর শরৎচন্দ্রও নাকি স্বয়ং এসেছিলেন হাতিপোতা গ্রামে। তখনই তিনি জানতে পারেন দেবদাস-পার্বতীর কাহিনি। এই ধারণার পালে আরও হাওয়া দিয়েছে উপন্যাসের এই কটি বাক্য: ‘পার্বতীর পিতা কাল বাটী ফিরিয়াছেন। এ কয় দিন তিনি পাত্র স্থির করিতে বাহিরে গিয়াছিলেন।...প্রায় কুড়ি-পঁচিশ ক্রোশ দূরে বর্ধমান জেলার হাতিপোতা গ্রামের জমিদারই পাত্র।’ এমনকি উপন্যাসে উল্লিখিত পাণ্ডুয়া রেলস্টেশন ও হাতিপোতা গ্রামের দূরত্বও নাকি বাস্তবের সঙ্গে মিলে যায়, এমনটাই দাবি গ্রামবাসীর। সূত্র: আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৮ আগস্ট ২০১২

চলচ্চিত্রে দেবদাস-ঝড়

দেবদাস-এর কাহিনি নিয়ে এখন পর্যন্ত বিভিন্ন দেশে ও ভাষায় নির্মিত চলচ্চিত্রের সংখ্যা ১৬। ১৯২৯ সালে দেবদাস অবলম্বনে নির্বাক চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। নীতিশচন্দ্র মিত্রের পরিচালনায় সেই ছবিতে দেবদাস চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন ফণী বর্মা। প্রযোজনায় ছিল ইস্টার্ন ফিল্ম সিন্ডিকেট। ১৯৩৫-এ দেবদাস আসে সবাক চলচ্চিত্র হিসেবে। নিউ থিয়েটার্সের প্রযোজনায় ছবির পরিচালনা ও নায়কের ভূমিকায় ছিলেন প্রমথেশ বড়ুয়া। তিনি পরে হিন্দি ও অসমিয়া ভাষায়ও দেবদাস নির্মাণ করেন।

১৯৭৯ সালে উত্তম কুমার ও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় একসঙ্গে অভিনয় করেন দেবদাস ছবিতে। িদলীপ রায় িনর্মিত এ িসনেমায় সৌমিত্র ছিলেন দেবদাস ও উত্তম ছিলেন চুনীলালের ভূমিকায়। আর পার্বতী চরিত্রে িছলেন সুমিত্রা মুখোপাধ্যায়। উর্দুতেও নির্মিত হয়েছে দেবদাস। বাংলাদেশে দেবদাস-কাহিনি অবলম্বনে মোট দুটি সিনেমা নির্মিত হয়, দুটির পরিচালকই প্রয়াত চাষী নজরুল ইসলাম। সূত্র: ওগউই

দেবদাস (ডাউনলোড লিংক)




SHARE THIS

Author:

Souls Sound is a leading technology media property, dedicated to technology trends, important software, biggest collection of song lyrics, album information, biggest book library, technology tutorial, literature news and reviewing latest topics.

0 comments: